Loading..

খবর-দার

০৫ জুলাই, ২০২১ ০৮:২৪ অপরাহ্ণ

গৌরবোজ্জ্বল অতীত, নিষ্প্রভ বর্তমান, অনিশ্চিত আগামী

১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০০ বছর পূর্ণ করল। ১৯২১ সালে যখন এ যাত্রা শুরু, এটি তখন ছিল পূর্ব বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের সমাজের বেড়ে ওঠার, গড়ে ওঠার পীঠস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত নিয়ে গর্ব করা যায়। শুরু থেকেই অনেক প্রখ্যাত জ্ঞানতাপস এখানে অধ্যাপনা করেছেন। বিগত শতকের চল্লিশের দশক থেকেই পূর্ব বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের যাঁরা দিকপাল, তাঁদের অধিকাংশই এ প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি। প্রশাসনের পদাধিকারীরাও দীর্ঘকাল প্রায় সবাই এসেছেন এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ ২৯-৩০ জুন প্রথম আলোয় তাঁর দুই পর্বের লেখায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে সূচনাপর্ব থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত যে তিনটি অধ্যাদেশ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে, তিনটিতেই সরকারি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার প্রয়াস সুস্পষ্ট। তা সত্ত্বেও আমার মনে হয়, নিয়মনীতি মোটামুটি মেনে চলার সংস্কৃতির কারণে অন্তত একাডেমিক কার্যক্রম বা শিক্ষক নিয়োগে মেধার মূল্যায়ন খুব একটা বিঘ্নিত হয়নি। ফলে লেখাপড়ার ন্যূনতম মান বজায় রাখা সম্ভব ছিল। বর্তমান শতাব্দীতে এসে এ কথা আর জোরগলায় বলা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক কালে নিয়ন্ত্রণের এ প্রবণতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে এবং যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে দলীয় পরিচয়ে কম যোগ্যদের অগ্রায়নের অভিযোগ পত্রপত্রিকায় নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈশ্বিক র‍্যাঙ্কিংয়ে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে আমরা জ্ঞান অর্জন করতে যাই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুধু জ্ঞান বিতরণ নয়, জ্ঞান সৃষ্টিও বটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৭ হাজার ছাত্র, প্রায় দুই হাজার শিক্ষক, ৮৪টি বিভাগ। গত ২০ বছরে কয়টি গবেষণা হয়েছে, যার ফলাফল বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক পর্যায়ে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সম্মানজনক পরিচিতি দিয়েছে? মেধার যে অভাব আছে, তা তো নয়। আমাদের ছেলেমেয়েরাই তো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে উৎকর্ষের পরিচয় দিচ্ছে। সমস্যাটা তো তাহলে খুঁজতে হবে পরিবেশ এবং ব্যবস্থাপনার মধ্যে।

রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে সবকিছুর। পঞ্চাশের দশক থেকেই এ দেশের রাজনীতি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় সমার্থক হয়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এরশাদ স্বৈরাচারের পতন পর্যন্ত অধিকার আদায়ের প্রতিটি গণ-আন্দোলনে অগ্রবর্তী ভূমিকা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের। এর মূল শক্তি ছিল অশুভ, অসত্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারুণ্যের স্বভাবজাত দ্রোহের আগুন। সে আগুনের ছিটেফোঁটাও কি দেখা গেছে গত ৩০ বছরে? অথচ ছাত্ররাজনীতি তো বহাল আছে আরও প্রকটভাবে। পরিবর্তনটা তাহলে হলো কোথায়?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির ব্যারোমিটার হচ্ছে ডাকসু। আর ডাকসু হচ্ছে এক প্রতিষ্ঠান, যা ছিল বরাবর সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আইয়ুব খানের যখন দোর্দণ্ড প্রতাপ, এনএসএফ আর পাঁচপাত্তু যখন ত্রাস, ছাত্রলীগের তোফায়েল আহমেদ কিন্তু তখন ডাকসুর সহসভাপতি আর উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের নায়ক। ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের সময়ও ডাকসুর নেতৃত্ব ছাত্রলীগের হাতে, স্বাধীনতাসংগ্রামে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া গ্রুপ ডাকসুর দখল নেয়, হল সংসদগুলো ভাগাভাগি হয় দ্বিধাবিভক্ত ছাত্রলীগের মধ্যে। ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ যখন ভরাডুবির সম্মুখীন, ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের মাধ্যমে নির্বাচন বানচাল হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগপন্থী ছাত্রলীগ কিছুদিন গা ঢাকা দিতে বাধ্য হয়। ডাকসুর পরবর্তী নির্বাচন হয় ১৯৭৯ সালে, যখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়। সরকারপন্থী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এ নির্বাচনে এমনকি জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের চেয়েও কম ভোট পায়। জগন্নাথ হলে আওয়ামীপন্থী ছাত্রলীগ এবং রোকেয়া হলে ছাত্র ইউনিয়ন জয়লাভ করে। ডাকসু এবং বাকি সব হলে জয় পায় জাসদপন্থী ছাত্রলীগ। পরের দুটি নির্বাচনেও জয়ী হয়েছিল জাসদ-বাসদপন্থীরা। এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর তাঁর দলের একটি ছাত্রসংগঠন গড়ে ওঠে, কিন্তু এ সময়ের দুটি নির্বাচনেও ডাকসুর নিয়ন্ত্রণ ছিল সরকারবিরোধী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের হাতে। ভোট দেওয়ার প্রকৃত সুযোগ পেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কখনোই সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনকে জয়যুক্ত করেনি।পরিবর্তনটা এখানেই। ১৯৯১ সাল থেকে নির্বাচিত সিভিলিয়ান সরকারগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ সরকারবিরোধী ছাত্রদের হাতে দিতে রাজি হয়নি, আর সে লক্ষ্য পূরণে ডাকসু নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হতে দেয়নি। ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সরকারি দলসমর্থিত ছাত্রসংগঠনের হাতে আর সরকারবিরোধীদের ক্যাম্পাসে অবস্থানই দুষ্কর হয়ে পড়ে। শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা লেজুড়বৃত্তিতে লিপ্ত, তাঁরাও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়েন। দ্রোহের কণ্ঠ সম্পূর্ণ চাপা পড়ে যায়, সরকারের সর্বকর্মে শর্তহীন সমর্থন জোগানোই হয়ে ওঠে ছাত্রসংগঠন ও শিক্ষকদের কাজ। ফলে অনিয়মই হয়ে গেছে নিয়ম, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের অধোগতি হয়ে গেছে অপ্রতিরোধ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য হয়ে গেছে আর্থিক সুবিধা লাভ এবং পদপদবি অর্জন। জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান অর্জন বা অধিকার আদায়ে ভূমিকা গ্রহণ নয়।

প্রিয় এ বিদ্যাপীঠের জন্য তাহলে কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়, তাই শুধু এখানে সুস্থ রাজনৈতিক ধারা ফিরে আসবে, এটা হবে অতি প্রত্যাশা। অধোগতি ঠেকাতে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে খানিকটা সম্মানজনক অবস্থানে তুলে আনতে তাহলে কী করা যায়, এ নিয়ে শিক্ষাবিদদের এবং শিক্ষা প্রশাসনকে ভাবতে হবে। মোক্ষলাভের রাজনীতি যাঁরা করতে চান, করতে থাকুন। অন্তত যাঁরা জ্ঞানচর্চায় লিপ্ত থাকতে চান, তাঁদের জন্য কিছু বাড়তি সুযোগের সৃষ্টি হোক। নতুন নতুন বিভাগ সৃষ্টি না করে প্রচেষ্টা হোক বিদ্যমান বিভাগগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে। বরাদ্দ বাড়ুক গবেষণায়। ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধির অসুস্থ প্রবণতা বন্ধ হোক, বরং আবাসিক সুবিধার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হোক শিক্ষার্থী ভর্তি। প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা আছে সরকারের, আছে অনেক কলেজও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হোক দেশের সবচেয়ে মেধাবীদের জন্য, আর তাদের জন্য আর্থিক সহায়তা বাড়ুক অনেক। সেই সঙ্গে ছাত্রদের সবচেয়ে বড় যে দুর্দশা, আবাসনের অপ্রতুলতা, তার অবসান হোক। মিছিলে যাওয়ার বিনিময়ে গণরুমে থেকে ডিগ্রি অর্জন সম্ভব, প্রকৃত জ্ঞানচর্চা দুরূহ।

বিগত ১০০ বছরে বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজ বিনির্মাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনবদ্য অবদান রেখেছে। অনুজ্জ্বল বর্তমানকে পেছনে ফেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাক আগের চেয়েও গৌরবোজ্জ্বল অবস্থানে, প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে শতবর্ষে এই আমাদের প্রত্যাশা।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব