Loading..

খবর-দার

২৩ জুলাই, ২০২১ ০৭:৪৫ অপরাহ্ণ

@@@ পিএইচডি কোর্সে এ কেমন শর্ত @@@

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা পিএইচডি করেছেন, তাদের একটি বড় অংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজ সহকর্মীর অধীনে পিএইচডি করার সুবর্ণ সুযোগ বিশ্বের কম বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে। তবে আমাদের দেশে শিক্ষকদের পিএইচডি গবেষণায় যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা বিশ্ববিদ্যালয়ই সহজ করে দিয়েছে। ফলে পিএইচডি ডিগ্রি পেতে তাদের তেমন একটা বেগ পেতে হয় না। শিক্ষকদের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পেশার মানুষের পিএইচডি করার আগ্রহ বাড়ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী ছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দেশের বাইরে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বাধা পাচ্ছে না, ঠিক তখন নিজ দেশে 'বিশ্রী' নিয়মের জালে পিএইচডি করার সুযোগ মিলছে না। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডিতে শিক্ষার্থী ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিটি দেখার পর খুবই হতবাক হয়েছি। শিক্ষাগত যোগ্যতায় পিএইচডিতে ভর্তির এই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, 'দেশের কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি প্রোগ্রামে সরাসরি ভর্তি হতে পারবেন না।' তার অর্থ দাঁড়াল, আপনি যদি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করে থাকেন, তাহলে আপনি সরাসরি এই প্রোগ্রামে ভর্তির যোগ্যতা রাখেন, আর যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার জন্য সেই সুযোগ নেই।
এমন বিজ্ঞপ্তি দেখার পর যে কারও মনে হতে পারে, বিশ্বে এটি একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য 'পাবলিক' বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হলে আপনাকে মাস্টার্স-পরবর্তী ও পিএইচডি-পূর্ববর্তী দুই বছর মেয়াদি এমফিল কোর্স পাস করার পরই পিএইচডিতে ভর্তি হতে হবে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একই ধরনের যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এই ঝিল্লিবদ্ধ নিয়ম কারা কাদের স্বার্থে তৈরি করেছে, তা বুঝতে বাকি নেই। শুধু সামাজিক ইগোর জন্য যদি এই বর্ণবাদী যুক্তি তোলা হয়, তাহলে সেটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক ধারাচ্যুত হয় বৈকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশের শুরুতে বর্ণ, ধর্ম, ধনী-গরিব সবার জন্য উচ্চশিক্ষার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। অথচ আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একটা সীমানা তৈরি করে দিয়েছে, কারা তাদের পাঠ গ্রহণ করতে পারবেন, কারা পারবেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত ছিল সবার জন্য সমানভাবে উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া। বিভিন্ন কালচারের ছেলেমেয়েদের সন্নিবেশের সুযোগ দিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার করা। কিন্তু আমরা সেই উদারতা দেখাতে পারছি না। যেখানে দেশে পিএইচডি করার মতো শিক্ষার্থী সংখ্যায় অপ্রতুল, সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর এমন বিজ্ঞপ্তি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের কাছ থেকে আমরা প্রত্যাশা করি না।
আমরা যারা দেশের বাইরে পিএইচডি করেছি, তারা ভালো করে জানি, পিএইচডি করতে হলে একজন শিক্ষার্থীর কোন কোন যোগ্যতা জরুরি। বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিএইচডির নোটিশ জারি করলে তারা কখনোই বলে না আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের, কোন দেশের নাগরিক হতে পারবেন। সেখানে থাকে না আপনার স্কুল-কলেজের ফলাফল কেমন ছিল, তা দিয়ে আপনাকে পরখ করার। এখানে মুখ্য বিষয় থাকে, প্রার্থীর পিএইচডি করার যোগ্যতা কতটুকু। আর সেটি নির্ধারণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কমিটি। সেখানে সম্ভাব্য পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। অথচ আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিএইচডি ভর্তিতে এসএসসি/এইচএসসির যোগ্যতা টেনে এনেছে, যা দিয়ে কখনোই একজন শিক্ষার্থীর পিএইচডি করার যোগ্যতা মাপা সম্ভব নয়।
শুধু তাই নয়, এই বিজ্ঞপ্তিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরত ভর্তিচ্ছু ছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত প্রার্থীদের কমপক্ষে এক বছরের ছুটি নিয়ে পূর্ণকালীন পিএইচডি গবেষণা করতে বলা হয়েছে। এটা সুস্পষ্ট বৈষম্য। ধরলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরত অবস্থায় যারা পিএইচডি করতে আগ্রহী, তারা হলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাহলে তাদের ক্ষেত্রে কেন পূর্ণকালীন পিএইচডি করার কথা বলা হলো না? কেন তারাও প্রতিষ্ঠান থেকে ছুটি চাইবেন না?
এ ধরনের বিতর্কিত শর্ত তুলে আমরা উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছি। আমরা উচ্চশিক্ষার মানের সমান্তরাল রেখা নিরূপণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি। অথচ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সংখ্যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কয়েকগুণ। স্বীকার করছি, শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান সমান নয়, তবে এমনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যাদের শিক্ষা ও গবেষণার মান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমান না হলেও কম হবে না। তাহলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কপালে কেন এই খÿ? কেন আমরা বৈষম্যহীন উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে পারছি না?
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ছেলেমেয়েরা কি তাহলে দেশের বোঝা হয়ে যাচ্ছে? তাদের মেধার মূল্যায়নের সুযোগ না দিয়ে আগে থেকে মাঠের দর্শক সারিতে পাঠানো কখনোই সভ্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কাজ হতে পারে না। বরং তাদের মাঠে এনে পরখ করার সুযোগ দেওয়া মাল্টিকালচারাল শিক্ষাব্যবস্থার প্রারম্ভিকতা হতে পারত। ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করে তাদের যোগ্যতা মাপা যেত। কে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সেটা না দেখে বরং কার যোগ্যতা কেমন সেটা দেখার দায়িত্ব নিন।
এসব না করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হওয়ার খেসারত স্বরূপ আপনারা তাদের এমফিল করার জন্য পাঠাচ্ছেন, যে ডিগ্রিটির গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বের অনেক দেশেই নেই। মনে রাখতে হবে, এটি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, এখনকার শিক্ষা সব শ্রেণির মানুষের জন্য সমানভাবে প্রাপ্য অধিকার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হলেই যে একজন শিক্ষার্থী খারাপ বনে যাবে, তা ভেবে তাদের অবমূল্যায়ন করা হবে, তা হতে দেওয়া যায় না।
শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শ্রেণিবৈষম্য দূর করতে হবে। এসব আজগুবি শর্তারোপ করে আপনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণেচ্ছুদের নিরুৎসাহিত করতে পারেন না। বরং দেশের ভেতরে গবেষণার আধার তৈরি করার জন্য বেশি বেশি পিএইচডি করার সুযোগ দেওয়া উচিত। গবেষণার মানদণ্ডের হিসাব কষে সবার জন্য উচ্চশিক্ষা আমাদের আগামী দিনের পাথেয় হওয়া উচিত। এর বাইরে এসব বিতর্কিত যোগ্যতা দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের সুযোগ নেই, বরং গবেষণায় এগিয়ে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের তৈরি করা। প্রিন্ট সংস্করণ