সিনিয়র শিক্ষক
১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ০৮:২৪ অপরাহ্ণ
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের প্রকল্প শীতলক্ষ্যার তীরেই ফিরে এল ঐতিহ্যের মসলিন
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের প্রকল্প
শীতলক্ষ্যার তীরেই ফিরে এল ঐতিহ্যের মসলিন
আজ থেকে ১৭০ বছর আগের কথা। ১৮৫১ সালের দিকে ঢাকার দয়াগঞ্জ থেকে ৫০০ নৌকার একটি বহর শীতলক্ষ্যা নদী আর বালু নদের মোহনায় গিয়ে ভেড়ে। যেখানে নৌকার বহর ভিড়েছিল, সেই জায়গা এখনো আছে, নাম বহরঘাট। নৌকার যাত্রীরা সবাই ছিলেন মসলিন সানা কারিগর। তাঁরা সেখানে শীতলক্ষ্যা নদী ও বালু নদের মোহনার ছোট্ট চরে বসতি গড়ে তোলেন। সে আলোকে জায়গাটির নামকরণ হয় সান্দাতলা গ্রাম।
সেই মোহনার কাছেই আবার গড়ে তোলা হয়েছে ঢাকাই মসলিন হাউস। উদ্দেশ্য, গবেষণার মাধ্যমে মসলিন শাড়ির ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন। মসলিন হাউসের প্রধান ফটকে লেখা হয়েছে, ‘হারানো ঐতিহ্যের সন্ধানে দেশ’। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরেই বাণিজ্যিকভাবে শাড়ি উৎপাদন শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদহাউসটির ভেতরে যে ঘরে বসে তাঁতি সারি সারি হস্তচালিত তাঁতে ঐতিহ্যবাহী মসলিন কাপড় বুনছেন ও চরকায় সুতা কাটছেন, সেটির নাম রাখা হয়েছে ‘মলমল খাস স্পিনিং ও উইভিং শেড’। আর মসলিন শাড়ি প্রদর্শনের জন্য যে ঘর বানানো হয়েছে, তার নাম ‘আব-ই-রওয়ান’ প্রদর্শনী কেন্দ্র। ‘মলমল খাস’ ও ‘আব-ই-রওয়ান’ খুবই অভিজাত দুটি মসলিন কাপড়ের নাম। সেখানে দাঁড়াতেই মনে হলো, ইতিহাসের হৃদয় খুঁড়ে তুলে আনা হয়েছে মসলিন সভ্যতার সেই হারানো দিন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নতুন ঢাকাই মসলিন হাউস এখন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের অপেক্ষায়।
বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড। পুনরুদ্ধারের কাজটি ২০২০ সালে শেষ হয়েছে। ঢাকাই মসলিন ইতিমধ্যে জিআই স্বত্বের অনুমোদন পেয়েছে। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর এ-সংক্রান্ত গেজেটও প্রকাশিত হয়। জানা গেছে, ১২ কোটি ১০ লাখ টাকার প্রকল্পটি গবেষকেরা মাত্র ৪ কোটি টাকায় সম্পন্ন করেছেন। বাকি টাকা ফেরত দিতে চাইলে সরকার প্রকল্পটি সম্প্রসারিত করে ঢাকাই মসলিন হাউস তৈরির কাজকে এর সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হবে আগামী জুনে। আর ‘ঢাকাই মসলিন বাণিজ্যিকীকরণ’ নামে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হবে আগামী জুলাই থেকে। সেটির মেয়াদ হবে তিন বছর।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে যেখানে ঢাকাই মসলিন হাউস গড়ে তোলা হয়েছে, সেটি তারাব পৌর এলাকায় পড়েছে। সম্প্রতি এক সকালে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে প্রকল্পটির পরিচালক মো. আইয়ুব আলী জানান, শীতলক্ষ্যা নদীতীরের হাওয়া মসলিন কাপড় বুননের জন্য উপযোগী। সে জন্যই সম্ভবত ঢাকার দয়াগঞ্জের মসলিন সানাশিল্পীরা এখানে এসে সানা তৈরির কাজ শুরু করেন এবং বসতি গড়ে তোলেন। তাঁরা দেশে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশেও সানা রপ্তানি করতেন। এসব কারিগর ছিলেন মুসলিম। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহে যোগ দেওয়ার অপরাধে তাঁদের সেখান থেকে বিতাড়িত করা হয়। কাকতালীয়ভাবে ১৭০ বছর পর আবার বহরঘাটের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে ঢাকাই মসলিন হাউস।
সানা হচ্ছে তাঁতের একটি অংশ। এটি বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়। দেখতে চিরুনির মতো সুবিন্যস্ত। শাড়ি বুননের সময় এর ভেতরে সুতা এক দিক থেকে আরেক দিকে লম্বালম্বিভাবে বিন্যস্ত থাকে।
মূলত বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) পরিত্যক্ত জুট প্লান্টিক প্ল্যান্টের জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে ঢাকাই মসলিন হাউস। আইয়ুব আলী জানান, আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মসলিন উৎপাদন শুরু করা যাবে বলে তাঁরা আশা করছেন।
নদীর ঘাটেই কার্পাস নামে একটি ছোট্ট কুটির তৈরি করা হয়েছে। পর্যটকেরা এসে এই কুটিরেই বসবেন। তখন তাঁদের প্রজেক্টরের মাধ্যমে মসলিন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হবে। রূপগঞ্জের তারাব পৌরসভার মেয়র হাসিনা গাজী গত ১৩ নভেম্বর কুটিরটির উদ্বোধন করেন।
মসলিন হাউসের ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, পরিত্যক্ত জুট প্লান্টিক প্ল্যান্টে নতুন রং লাগানো হয়েছে। ডান পাশে তৈরি করা হয়েছে মসলিনশিল্পীদের শিশুদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার, আব-ই-রওয়ান প্রদর্শনী কেন্দ্র, মলমল খাস স্পিনিং ও উইভিং শেডসহ আরও অনেক কিছু।
জানা গেছে, প্রকল্পের গবেষকেরা লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে সর্বোচ্চ ৫০০ মেট্রিক কাউন্টের সুতায় বোনা মসলিন শাড়ির সন্ধান পেয়েছেন। মলমল খাস স্পিনিং ও উইভিং শেডে বসে একই সঙ্গে ১৪ জন নারী চরকায় ৭৩০ মেট্রিক কাউন্টের সুতা কাটছেন। এ বিষয়ে মোট ১১০ জন নারীকে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।