Loading..

প্রকাশনা

১৪ ফেব্রুয়ারি , ২০২২ ১০:৩৯ অপরাহ্ণ

নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধ-ভাবনা ও আমাদের করণীয়...

নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধ-ভাবনা ও আমাদের করণীয়...

শিক্ষার্থীদের কুচকাওয়াজ, শরীরচর্চা ও ডিসপ্লে দেখার জন্য প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ আমি মাঠে যাই। খুব ভালো লাগে এসব অনুষ্ঠান দেখতে। এসব অনুষ্ঠানে আজকের শিশু-কিশোর, যারা আগামী দিনের দেশের কান্ডারি, তাদের চিন্তা-চেতনা ডিসপ্লের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করে। ভারি সুন্দর হয় ডিসপ্লেগুলো। শিক্ষার্থীরা খুব কষ্ট করে অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে তাদের মনের মতো করে সাজায় ডিসপ্লেগুলো। এগুলো আসলে শিক্ষার্থীদের মনের দর্পণ। মনের জানালা দিয়ে একটু উঁকি দিলেই ওদের মনের পুরো জগৎই দেখে নেওয়া যায়।

যে কোন স্কুলের কথাই বলি না কেন। ১৬ ডিসেম্বর বা ২৬ মার্চ এলেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিসপ্লেতে অংশগ্রহণের জন্য বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়। একটু সহযোগিতা পেলেই ওরা সংগঠিত হয়ে যায়। প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। নিজেরাই বিভিন্ন থিম দাঁড় করিয়ে শিক্ষক–শিক্ষিকাদের সঙ্গে শেয়ার করে। আমি ওদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে, ওদের সৃজনশীলতা দেখে আনন্দিত হই। খুব সুন্দর করে ডিসপ্লের প্রস্তুতি নেয়, যাতে যেকোনো মূল্যে প্রতিযোগিতায় প্রথম হতে পারে। প্রথম হতে না পারলে মন খারাপ করে। ওদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে শান্ত করা হয়। শিশু-কিশোরদের মন তো, সামান্যতেই খারাপ হয়ে যায়। আবার অল্প সান্ত্বনাতেই বিক্ষুব্ধ ভাবটা কেটে যায়।

একটা বিষয় দেখে আমি খুব চমকিত হই। ডিসপ্লেতে শিক্ষার্থীরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। তাদের ডিসপ্লেতে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও সাহসিকতা যেমন উঠে আসে, তেমনি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উঠে আসে পাকিস্তানি বাহিনী আর রাজাকারদের নীচতা ও বর্বরতা। শুধু তা–ই নয়, শিক্ষার্থীরা তাদের অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে আনে কৃষক, শ্রমিক, নারী-পুরুষ, ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বসাধারণের দুঃখ–দুর্দশার কথা। তারা বইপত্রে মুক্তিযুদ্ধের কথা পড়ে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে যে তারা গভীরভাবে উপলব্ধি করে, তা তাদের ডিসপ্লে বা অভিনয় না দেখলে বোঝা কঠিন।

এসব ডিসপ্লে, নাচ, গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে তারা যে শুধু একাত্তরকে তুলে আনে, তা-ই নয়, বরং সমসাময়িক কালের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও তুলে আনে। যেমন মাদক, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ইভ টিজিং, বাল্যবিবাহ ইত্যাদির কুফল সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করে।

এবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এবারের ডিসপ্লেও হয়েছে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে জমজমাট ও বর্ণাঢ্য। এতে শিক্ষার্থীরা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে আমাদের বিজয়ের মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর সংগ্রামী জীবনের কথা। তুলে এনেছে বাঙালিদের চূড়ান্ত বিজয় ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লজ্জাজনক পরাজয়ের কাহিনি। তুলে ধরেছে করোনার ভয়াবহতা আর এর বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের সংগ্রামের কথা। তারা তুলে ধরেছে বাংলাদেশকে ডিজিটাল দেশে রূপান্তরের কথা। পাশাপাশি তুলে ধরেছে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত রূপকল্পের কথাও উঠে এসেছে কোন কোন প্রতিষ্ঠানের ডিসপ্লেতে। এককথায় একাত্তর থেকে শুরু করে সমসাময়িক কালের সব ধরনের বিষয়ই সর্বসাধারণের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে আমাদের কোমলমতি শিশু–কিশোরেরা।

আমাদের শিশু–কিশোরদের উচ্ছ্বাসপূর্ণ উপলব্ধি ও অভিব্যক্তি দেখে বেশ কয়েকবার চোখের পানি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি। ওরা দেশের এত সব বিষয় নিয়ে ভাবে! ভাববেই তো। ওরা তো আর আগেকার দিনের শিশু–কিশোরদের মতো নয়। ওদের সামনে সারা বিশ্বের তথ্যভান্ডার খোলা। ইন্টারনেটের এই যুগে ওরা একটা মাত্র ক্লিকের মাধ্যমেই শতসহস্র তথ্য হাতের কাছে পেয়ে যায়। সহজেই জেনে যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধে কার কী ভূমিকা ছিল। বর্তমানে কে কী করছে। আমি ভাবি, এই অতি বুদ্ধিমান বর্তমান প্রজন্মের একটু পরিচর্যা হলে ওরা সহজেই সমৃদ্ধ জনসম্পদে পরিণত হবে। ২০৪১ সালের যে উন্নত বাংলাদেশের কথা আমরা বলছি, তার কান্ডারি তো হবে ওরাই। তাই ওদের দেশপ্রেমিক আর উন্নত চিন্তা–চেতনার নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো তো আমাদের অত্যন্ত জরুরি একটা কাজ।

আমরা যারা এ দেশের সিনিয়র নাগরিক, তাদের দায়িত্ব অনেক। বিশেষ করে আমাদের কার্যকলাপ শিশু–কিশোরদের সামনে যদি আদর্শস্থানীয় না হয়, তবে তো ওদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে। আমরা শুধু ছোটদের সুন্দর সুন্দর উপদেশ দেব আর নিজেরা উল্টোপাল্টা কাজ করব, তা কী করে হয়? লাখো শহীদের রক্তে ভেজা আমাদের এই মাটি। এখানে দাঁড়িয়ে বুকভরে নিশ্বাস নেওয়ার অধিকার সবার আছে। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষার্থীদের সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠার, আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষা লাভ করার ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার অধিকার আছে। ওদের এসব অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা সুস্থ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারলেই একটা সুন্দর সমাজ গড়ে উঠবে, যা উন্নত ও আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহায়ক হবে।

আমাদের বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধকে জানে পড়ে, নাটক–সিনেমা দেখে আর ইন্টারনেট ঘেঁটে। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ নাটক–সিনেমার ক্ষেত্রেই দায়সারা গোছের কাজ হচ্ছে। আমাদের দরকার আরও অনেক হুমায়ূন আহমেদ, নির্মলেন্দু গুণ, জহির রায়হান। আমাদের বিজয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় একটা সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। এমন আরও অনেক ভালো কাজ দরকার। আমাদের ভবিষ্যতের কান্ডারিদের জাতির প্রকৃত ইতিহাস জানার সুযোগ করে দিতে হবে।তাদের জানতে দিতে হবে এ দেশের অতীত ইতিহাস ও তার ক্রম বিবরতনের ধারা।

 আমাদের জাতির সুর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাগণ কোন প্রত্যয়ে ও কোন তামান্না বুকে ধারন করে মুক্তি যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। সেই প্রত্যয় যদি তারা না জানে তবে তারা কোন বাংলাদেশ গরে তুলবে। তারাই তো ভবিষ্যত উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মানের দক্ষ কারিগর হতে চলেছে। যে আদর্শ ও নৈতিক মুল্যবোধ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন করা হয়েছে সেই আদর্শ ও মুল্যবোধ আমাদের শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে তবেই তো তারা সেই লক্ষ্যে নিজেকে প্রস্তুত করবে। যদি তা না করা হয় তবে স্বাধীনতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেমন মুখ থুবড়ে পড়বে তেমনি আমাদের স্বাধীনতা ৫০ কেন ১০০ বছর পরেও প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি শুন্যের কোঠায়ই থাকবে।।

সংগ্রহ ও সম্পাদনায়

মোঃ ময়দুল ইসলাম। (Moydul Islam)

শিক্ষক ও শিক্ষক প্রশিক্ষক

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি