Loading..

পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি/ইমেজ

২০ জুন, ২০২২ ০৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

পূর্বের মানচিত্রে বহ্মপুত্র নদ

আড়াইশ বছর আগের সেই যুগান্তকারী বন্যা যা একটা আস্ত নদীকে মেরে ফেলেছিল। 


১৭৮২ সালের কথা। সিপাহী বিদ্রোহের জেরে তখনো জেরবার বাংলার সমাজ জীবন। ২৫ বছর পরও বাংলার এখানে ওখানে টুকটাক বিদ্রোহ থামেনি। এরকম এক বর্ষাকালে দু একদিন পর পর

ভুমিকম্প হচ্ছে। একদিন বেশ জোরে কয়েকটা ঝাঁকি। ব্রহ্মপুত্র তীরের লোকজন খানিক দিশেহারা। প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র নদ বইছে ময়মনসিংহের বুক চিরে। 


আসামের কোল বেয়ে কুড়িগ্রামকে পাশ কাটিয়ে বাংলা স্পর্শ করা এই নদী কিছুটা খ্যাপাটে। হিমালয় অববাহিকার নদীগুলো উঁচু পর্বতে জন্মনিয়ে ঢাল বেয়ে তরতরিয়ে নেমেছে দক্ষিণে, নীচের দিকে। এই নদি তার উল্টো। হিমালয়ের মানস সরোবরের কোলে জন্ম নিয়ে ছুটেছে পূর্ব দিকে। তিব্বত থেকে অরুণাচল হয়ে আসামে ঢুকে সেখান থেকে আবার পশ্চিমে বাঁক নিলো। তারপর এলো বাংলায়। 


এদিকে ভুমিকম্পে বিহ্বল লোকজন। সাহেবের দপ্তর থেকে জানানো হল টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষে ব্রহ্মপুত্র অঞ্চলের নিচের ভুমিতল অনেকটা উপরে উঠে এসেছে । এর ফল দেখা গেলো বর্ষায়। নদীর গভিরতা কমে যাওয়ায় নদী আর আগের মত পানি বইতে পারছেনা। অন্য বারের চেয়ে এবার বন্যা হলো বেশি। দুঃখি বাংলার জনজীবন দুঃখে চাপা পড়লো। 


বন্যা এদেশে কৃষকের জন্য আশির্বাদ হয়ে আসে। সে জানে বন্যা পরবর্তি পলির সহায়তায় উৎপাদন বৃদ্ধির নানা কৌশল। কিন্তু এই বন্যা তো সেরকম ৫/৭ দিনের নয়। পানি থাকলো অনেক দিন। মাটির ঘর গেলো ধ্বসে, খেতের লতাপাতা শস্য পঁচে গলে আর কিছুই রইলো না। কৃষকের মাথায় হাত, চারা নেই, বীজ নেই তার ভবিষ্যৎ ও যে অন্ধকার। আধাপেট খেয়ে দিন কাটলো কৃষকের। জনজীবনে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি দীর্ঘায়িত হল। এভাবে পরপর কয়েকবছর চললো বন্যার প্রকোপ। কৃষক দিশেহারা। তখনতো দেশের সবাই কোন না কোন ভাবে কৃষক। দুএকজন বাড়তি পেশায় জেলে বা মাঝি।


১৭৮৭ সাল এলো। বর্ষার আগমনি দিনগুলো মোটেই ভাল ছিলনা। বাপ চাচার শেখানো জ্ঞানে মনের মধ্যে কু ডাক ডাকলো। কি জানি কি হয়। আকাশের চেহারা ভালো না। মৌসুমি বায়ুর সুড়সুড়ি কেমন অচেনা ঠেকছে। শুরু হলো বৃষ্টি। তখনকার বাংলায় কোম্পানির শাসন মোটে শুরু হলো বলে। সরকারি দপ্তর গোছানোই হয়নি। নাই কোন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। মোগল বিদায় নিয়েছে কিন্তু তার জায়গায় কেউ এসে এঁটে বসেনি। বসার সময়ও হয়নি। 


আষাড়ের মাঝামাঝি। বৃষ্টি আর থামে না। ১০ দিন, ১৫ দিন এভাবে ১ মাস চললো। আকাশ তার সব দরোজা খুলে পানি উপচে দিলো বাংলা ও আসামের পাহাড়ে প্রান্তরে। বরাক নদীতে দু কুল ভাঙা ভরা স্রোত। সুরমা কুশিয়ারা উপচে উঠলো। বাংলার উপর দিকে মেঘালয়। তার দুই পাশ জড়িয়ে বাংলার দিকে চেয়ে থাকে অসম রাজ্য। বুকের কাছে নবজাতক শিশুর মত কুঁকড়ে আছে পার্বত্য ত্রিপুরা। এই তিন রাজ্যই পাহাড় কন্যা। কোথাও বালিমাটির পাহাড় কোথাও পাথরের মিশেল। অতি বৃষ্টিতে নদি ভরে যায় বালি আর পাথরের স্তুপে। এ এক অচেনা ভূমিরূপ। 


পাহাড়ি নদীর বুক চিরে ঘোরতর বেগে ছুটে এলো প্রবল বন্যার পানি। আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরায় শতাব্দীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হল। এমন বর্ষণ তখন বেঁচে থাকা কেউ দেখেনি। দেখবে কিভাবে? ম্যালেরিয়া আর কলেরায় তখন হাজারে হাজারে মানুষ মারা যেতো। শিশু মৃত্যু হত আকছার। নিজের দুটো সন্তান বাঁচাতে বাবা মাকে জন্ম দিতে হত আট নয়টি শিশু। তবেই যদি টিকে থাকে দুটো। মানুষের গড় আয়ু ছিল কম।। এমনই এক গ্রামীণ সমাজ ১৭৮৭ সালে বন্যার প্রলয়ের মুখোমুখি হলো। 


অতিবৃষ্টিতে ধ্বসে গেল বহু পাহাড়। বিস্তীর্ণ আসামের বালি, কাদা, পাথর বয়ে নিয়ে এলো ব্রহ্মপুত্রের সব উপনদী। এই বিপুল পলির ভার বইবার ক্ষমতা দুকুল উপচানো পানির রইলোনা। সমতলে এলে পানির স্রোত কমে যায়। বাহাদুরাবাদ ঘাট পেরিয়ে জামালপুরের কাছে যেখানে নদী পূর্বে ময়মনসিংহের দিকে বাঁক নিয়েছে সেই জায়গা হলো পানির স্রোতে বয়ে আনা পলি পাথর জমা হবার সুবিধাজনক জায়গা। পানির তোড়ে ব্রহ্মপুত্রের মুখে জমা হল লাখলাখ টন জঞ্জাল, পলি, পাথর। তাতে বন্ধ হয়ে গেল মূল নদির মুখ। থমকে গেল প্রবাহ। নদির পুরানো খাত বাদ দিয়ে পানি ছুটল বেপথে। আশেপাশের সমতল ভূমি ডুবিয়ে দুই কুল প্লাবিত করে নদি সৃষ্টি করলো নতুন খাত। এখনের যে যমুনা সেটা তখন মোটেও বিশাল ছিলো না। এর জায়গায় ছিলো বড়সড় এক খাল যা জনাই খাল নামে পরিচিত ছিলো। পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবল বেগে ছুটলো জনাই এর শীর্ণ খাত বেয়ে।। পানির চাপে কয়েক বছরের মধ্যে তার দুই কুল ভেঙে নদীর রূপ নিলো।।সৃষ্টি হলো নতুন অববাহিকা যা ব্রহ্মপুত্র - যমুনা অববাহিকা নামে পরিচিত হলো। প্রবাহ বঞ্চিত ময়মনসিংহের আদি ব্রহ্মপুত্র শীর্ণকায় হয়ে পরবর্তি ২০ বছরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিতি পেলো।


এখন যেরকম টানা বৃষ্টি হচ্ছে দিনের পর দিন ১৭৮৭ সালেও এমন বৃষ্টিতে ব্রহ্মপুত্র তার মূল খাত হারিয়ে যমুনার নতুন খাতে বইতে শুরু করেছিলো। এক অর্থে মৃত্যু ঘটেছিলো প্রমত্তা সেই ব্রহ্মপুত্রের। রেনেলের মানচিত্রে দেখা যাবে ব্রহ্মপুত্রের তখনকার প্রবাহের ভূমিচিত্র। এখনকার মানচিত্রের সাথে ২৫০ বছর আগের সেই মানচিত্রের অনেক অমিল। কত নতুন নদী সৃষ্টি হলো কত নদী মুছে গেল। 


আচ্ছা রেনেলটা যেন কে? 


নদ কোনটি আর নদী কোনটি এটা জানা আবশ্যক। 

সাধারণ বাংলায় নদনদী নিয়ে পৃথক কোন ভাবনা নেই কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণে আছে। যে সব স্রোতস্বিনীর নামের শেষ অক্ষরে আকার, উকার বা দীর্ঘউকার নেই সেগুলো পুরুষবাচক শব্দ বিবেচনায় নদ। আর যেসব স্রোতস্বিনীর নামের শেষ অক্ষরে আকার, উকার বা দীর্ঘউকার আছে সেগুলো স্ত্রীবাচক শব্দ বিবেচনায় নদী বিবেচিত হয়।

তাহলে নদের নাম হবে- কুমার, তুরাগ, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, কপোতাক্ষ, আত্রাই।

নদীর নাম হবে- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলি, বালু, সাঙ্গু, মাতামুহুরি। 


পৃথিবীর আর কোন ভাষার ব্যাকরণে লিঙগ নিয়ে এই সুমধুর বৈচিত্র্য নেই।


এবার জেনে নেই উপনদী আর শাখা নদীর পার্থক্য।

কোন নদী যেসব নদীর পানি পেয়ে নিজে সমৃদ্ধ হয় সেগুলো ঐ নদির উপনদী। 


যেসব নদীকে একটি নদী পানি দিয়ে সমৃদ্ধ করে সেগুলো ঐ নদীটার শাখা নদী। 


উপ নদী পানি দেয় বলে তা মূল নদীর উজানে অবস্থান করে। 

শাখা নদী পানি নেয় বলে কোন নদীর ভাটিতে অবস্থান করে।


ওহো, রেনেলকে নিয়ে তো লিখা হল না।

আমরা বরং তার মানচিত্রের উপর নজর বুলিয়ে আসি। ছবির ক্যাপশন পড়তে থাকি।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি