সহকারী অধ্যাপক
৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ ১২:৪৬ পূর্বাহ্ণ
মিরপুর মুক্তির যুদ্ধ এবং একজন শহিদ সেলিম
মিরপুর
মুক্তির যুদ্ধ এবং একজন শহিদ সেলিম
এক
আদর্শ মায়ের অতি আদরের সন্তান ছিল শহিদ লে. সেলিম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অন্নদাশঙ্কর
জুনিয়র হাইস্কুলে কৃতী ছাত্র হিসাবে বেড়ে উঠছিল সে। ওই স্থানে চুয়ান্নর ভুখা
মিছিলে যোগদান না করার জন্য মায়ের ভর্ৎসনা শিশু সেলিমকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহী
করে তোলে ওই বয়সে। এরপর চিকিৎসক বাবার সঙ্গে স্থানে স্থানে অবস্থান করে প্রথমে
ঢাকার নটর ডেম কলেজ, পরে রাজশাহীর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে স্থান করে নেয় সে। পড়াশোনা ও
অ্যাথলেটিকসে চমক লাগানো উজ্জ্বলতম খেলোয়াড় ও ছাত্রনেতা ছিল সেলিম। উনসত্তরে ছাত্র
আন্দোলনে প্রফেসর জোহার সঙ্গে রাজশাহীতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে গুলিতে
নিহত হন প্রফেসর জোহা। সাহসী সেলিম নিজেকে উজাড় করে দেয় বাংলার স্বাধিকার
আন্দোলনে। গণ-আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের স্থানে স্থানে ঘাঁটি গাড়া
অবাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা ও বাঙালিবিরোধিতা এক ভিন্নমাত্রায় রূপ নিয়েছিল।
একাত্তরের ফেব্রুয়ারি থেকে বিহারি ও ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সেনাদের হামলা দৃশ্যমান
হয় চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সৈয়দপুর, ঈশ্বরদী, খুলনা ও ঢাকার মিরপুরে। কখনো প্রকাশ্যে
বাঙালিদের ওপর গোলাগুলি করে পাকিস্তানি সেনারা।
এ
পরিপ্রেক্ষিতে উনসত্তরে আইয়ুবের বিদায়, ইয়াহিয়ার আগমন এবং নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে
দোলাচল ইত্যাদি ঘটনা এক সুতায় গাঁথা বলে মনে হচ্ছিল সেলিমের কাছে। মার্চের শুরুতে
যখন এসব সংঘাত চট্টগ্রাম ও ঢাকার মিরপুরে প্রকট আকার ধারণ করে, তখন সেলিম
সিদ্ধান্ত নেয় সে ঢাকায় ফিরে যাবে। ঢাকায় এসে সোজা সে ছুটে গেল ইকবাল হলে;
বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে ফিরল তেজগাঁওয়, নিজ বাসায়।
এরপর
এলো ৭ মার্চ-বঙ্গবন্ধুর সেই আগুন ঝরানো ভাষণ। সেই ভাষণ শুনে সবাই উদীপ্ত, আর সেলিম
যেন জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো জ্বলছে। তখন সে ঢাকায়, যারা সাবেক ইউওটিসির সদস্য, তাদের
নিয়ে সে কমিটি তৈরি করছে। তরুণদের রাইফেল ট্রেনিং দিচ্ছে। পিতার কর্তব্যস্থান
সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরের ইকুইপমেন্ট সেন্টারে তখন তৈরি হয়েছে এক ডজন বর্শা, সেই
সঙ্গে পাহারারত এক প্লাটুন পুলিশের কানে দেওয়া হয়েছে প্রতিরোধের মন্ত্র। যা হোক,
মায়ের উৎকণ্ঠা অতিক্রম করে সেলিম ২৫ মার্চ রাত ৯টায় ঘরে ফিরে এলো।
রাত
সাড়ে ১১টায় সমগ্র ঢাকা শহর যখন পাকিস্তানিদের আক্রমণে স্তম্ভিত, বিমূঢ় এবং
ক্ষেত্রবিশেষে ভীতসন্ত্রস্ত, তখন দুটি ভাই (সেলিম ও আমি) এক প্লাটুন পুলিশ নিয়ে
পাকিস্তানিদের রুখতে দাঁড়িয়ে গেল-পাকিস্তান সার্ভে অফিস, তেজগাঁও পলিটেকনিক্যাল
ইনস্টিটিউট, সাতরাস্তার মোড় এবং সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরের সামনে। সে এক অবর্ণনীয়
পরিস্থিতি।
৩১
মার্চ সেলিম ও আমি যোগ দিই দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে। ২ এপ্রিল সরাইল
ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিরোধ যুদ্ধে শরিক হই ক্যাপ্টেন মতিনের সঙ্গে। ১৪ এপ্রিল
লালপুরে পাকিস্তানির সঙ্গে সম্মুখসমরে প্লাটুন কমান্ডার হিসাবে অংশগ্রহণ করি। এরপর
শাহাবাজপুর, শমশেরনগর, নাসিরনগর, তেলিয়াপাড়া, হরষপুর, বেলোনিয়া, পরশুরাম,
মুকন্দপুরসহ অসংখ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা সেলিম।
সেলিম
তেলিয়াপাড়ার প্রতিরোধযুদ্ধে যে অসাধারণ ভূমিকা রাখে, তা ইতিহাসের পাতায়
স্বর্ণাক্ষরে লেখার মতো। একাত্তরের এপ্রিলের শেষে আমি সুবেদার ইসমাইলকে নিয়ে যখন
পাকিস্তানি পোস্টে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি, সেই সময় তারা আক্রান্ত হলো আজাদ
কাশ্মীর রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সেনা দ্বারা। ওই যুদ্ধে সুবেদার ইসমাইল নিহত হলে
পাকিস্তানিরা যখন চারপাশ থেকে একের পর এক বাঙ্কার উড়িয়ে দিচ্ছে, সেই সময় ক্যাপ্টেন
মতিন ও সেলিম ছুটতে ছুটতে প্রতি আক্রমণে পরাস্ত করে আগ্রাসী সেনাদের। দখল করে নেয়
ওদের তিন টনের একটি ট্রাক। এরপর কোনো কিছুর পরোয়া না করে অবিশ্বাস্যভাবে
মাইনফিল্ডের ওপর চালিয়ে ওই ট্রাক নিয়ে ফিরে আসে নিজেদের সীমানায়। আরেকদিন
পাকিস্তানি গোলায় তেলিয়াপাড়া ‘টি’ গার্ডেনে বটগাছের নিচে পাঁচ পাঁচটি মুক্তিযোদ্ধা
যখন শহিদ হলো আর লে. ফজলে হোসেন যখন আহত হলো, সে তখন প্রতি আক্রমণে একেবারে ঢুকে
পড়ে পাকিস্তানি বাঙ্কারে। হাতাহাতি যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে বিজয়স্মারক হিসাবে মৃত
পাকিস্তানির পদকটি ছিনিয়ে নেয় সে (এটি জমা রয়েছে মুক্তিযুুদ্ধ জাদুঘরে)। হরষপুরে
আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবন্দিকরণে তার ভূমিকা ছিল অতি উজ্জ্বল।
৪
ডিসেম্বর আখাউড়া যুদ্ধে লে. বদি শহিদ হলে লে. সেলিম দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল
রেজিমেন্টের ব্রাভো কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং আখাউড়া যুদ্ধজয়ে উল্লেখযোগ্য
ভূমিকা রাখে। অতঃপর শত্রুসেনাদের ঘাঁটির পর ঘাঁটি চুরমার করে ঢাকার কাছে ডেমরায়
আসে সেলিম। ১৬ ডিসেম্বর পড়ন্ত বেলায় সে বীর বাংলার মাটিতে প্রবেশ করে।
বঙ্গবন্ধু
হুকুম করেছিলেন অবরুদ্ধ মিরপুরে অবাঙালি এবং লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানিদের কাছ থেকে
অস্ত্র উদ্ধার করার জন্য। ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদ, লে. সেলিম, ডিএসপি লোদীসহ ৩০০
পুলিশ এবং ১৪০ সৈনিক মিরপুরে প্রবেশ করে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। মেজর জেনারেল
মঈনুল ভোরের কাগজে দেওয়া তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি লে. সেলিমকে মিরপুরে
নামিয়ে দিয়ে এসেছিলেন ওইদিন। ৩০ জানুয়ারি বেলা ১১টায় ঘটনাস্থলে সেলিম পৌঁছানো
মাত্রই গোলাগুলি শুরু হলো। ওই সময় ১২ নম্বর পানির ট্যাঙ্কের পেছন থেকে প্রথম গুলি
ছোড়া হয়। রাস্তার অপর পাশে কাঁঠালগাছের ফাঁক দিয়ে একটা গুলি আসে এবং সেটা সেলিমের
ডান বুকে লাগে। সেলিম প্রথমটায় লুটিয়ে পড়লে তাকে একটি ঘরে নিয়ে যায় হেলাল মোর্শেদ।
কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে এলে উঠে দাঁড়ায় সেলিম-নিজের শার্ট দিয়ে বেঁধে ফেলে তার
বুক। ঐশ্বরিক শক্তি যেন ভর করে তার দেহে। সৈন্যদের সে জানায়, ‘আমি বেঁচে থাকতে
তোমাদের ছেড়ে যাচ্ছি না।’ ঠাসঠাস গুলিতে লাল হয়ে ওঠে তার স্টেনগান। মুক্ত হয়
মিরপুর।
লে.
সেলিম এভাবেই শেষ করে নিজের জীবন। বিকালের দিকে জীবিত সেনাদের নিয়ে কালাপানির
ঢালের কাছে সে দাঁড়ায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ফ্যাকাশে ও ক্লান্ত সেলিম। তবু সে
সবাইকে উৎসাহ জুগিয়েছে বিল পার হয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে যেতে। নিজে পানিতে
নামেনি; বুকের ক্ষত পানিতে ডুবে যাবে এ কারণে। ক্লান্ত শরীরটা একটি গাছের আড়ালে
রেখে একটা একটা করে গুলি চালাচ্ছিল ঘাতকের দিকে। কভার ফায়ার দিয়ে সহযোদ্ধাদের সরে
যেতে সাহায্য করছিল সে। হয়তো ভাবছিল সাহায্য আসবে। সেদিন রাতে চাঁদ ছিল মেঘে ঢাকা।
ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছিল। না, কেউ তাকে উদ্ধার করতে যায়নি। একসময় আকাশের ফ্যাকাশে
চাঁদের দিকে তাকিয়ে বীর নক্ষত্র সেলিম চিরবিদায় নেয় পৃথিবী থেকে।