Loading..

পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি/ইমেজ

১৪ ফেব্রুয়ারি , ২০২৩ ১২:২০ অপরাহ্ণ

তারই ভুল হয় না, যিনি কাজ করেন না, বদিউর রহমান

প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ, বক্তব্য, সাক্ষাৎকার, বিরোধীদের প্রতি শানিত আক্রমণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধের সমৃদ্ধতা আমাকে মুগ্ধ করে। এজন্য আমি আগ্রহ সহকারে এগুলো শুনি, পত্রিকায় পড়ি এবং কোনো কোনোটি একাধিকবারও শুনি এবং পড়ি। তার বলার একটা ভিন্ন স্টাইলও আছে-কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানে কীভাবে উপস্থাপন করতে হবে, তাতেও তিনি বেশ দক্ষ ও পটু। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি যেমন রসবোধের মাধ্যমে তার বক্তব্যকে প্রাণবন্ত করে তোলেন, তেমনি আবার ধর্মসম্পর্কিত অনুষ্ঠানে তিনি বেশ গুরুগম্ভীর এবং ধীরস্থির-শান্তভাবে তার বক্তব্যকে শ্রোতাদের হৃদয়গ্রাহী করে তোলায় সচেষ্ট থাকেন। কিন্তু বিরোধী দল, বিশেষত বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ যখন তার আক্রমণের আওতায় এসে যায়, তখন যেন এক মহাপ্রলয় ঘটিয়ে দেন।

তখন তার চেহারায় কাঠিন্য এবং গলার আওয়াজের ধার আমরা দেখি এবং অনুধাবন করি। মোটের ওপর তার ভাষণ, বক্তব্য সাক্ষাৎকার বিষয়ভিত্তিক আমেজে ঋদ্ধ হয়। মনে পড়ে, যানজটের এক মহাফ্যাসাদে পড়ে আমি ঠিক সময়ে টেলিভিশনের সামনে হাজির হয়ে তার বিদেশ ফিরতি এক সংবাদ সম্মেলন দেখার জন্য বাস থেকে নেমে সিএনজিতে পাঁচশত টাকা গচ্চাও দিয়েছিলাম। এমন দুর্নিবার এক আকর্ষণ নিয়েই একেকটি ঘটনার পর এখন টের পাই শেখ হাসিনা এখন ঝানু রাজনীতিকে পরিণত হয়েছেন। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণের পর সাংবাদিকের কতদিন রাজনীতিতে থাকবেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ৫৭ বছরে উপনীত হওয়ার একটা কথা বলেছিলেন। তখন তার উত্তরে তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়াও কিছুটা প্রমোটরের ভূমিকার সহায়তা করেছিলেন মর্মে আমরা টেলিভিশনে দেখেছিলাম। সুদীর্ঘ ১৯ বছর প্রধানমন্ত্রিত্বে থেকে এখন হেন বিষয় নেই যেটাতে তিনি পাণ্ডিত্য রাখেন না। অবস্থাদৃষ্টে আপাতত আমরা আগামী মেয়াদেও তিনিই যে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, ইনশাল্লাহ তাতে কোনো ধরনের সন্দেহের অবকাশ দেখছি না। ফলে তার প্রধানমন্ত্রিত্ব হয়ে যাবে ২৫ বছর এবং একাধারে হবে চার মেয়াদ অর্থাৎ ২০ বছর-এ আশা আমরা করতেই পারি।

কিন্তু গত ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের ৪র্থ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি অন্যান্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে একটা মারাত্মক কথা বলেছেন। কথাটি অনেক পত্রিকা গুরুত্বসহকারে হেডলাইনও করেছে। তিনি বলেছেন, জনগণ যদি পরের নির্বাচনে বিজয়ী না করে, তাহলে জনগণের কাতারে চলে যাবেন। তার নিন্দুকেরাও শেখ হাসিনার মোট ১৯ বছর, টানা ১৪ বছরের শাসনামলে প্রভূত উন্নতি সাধনের কথা স্বীকার করে। সড়ক, বিদ্যুৎ, মাথাপিছু আয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি-কোনটিতে নজরকাড়া উন্নয়ন হয়নি? কিন্তু সমালোচনা রয়েছে গণতন্ত্র সীমিতকরণে, ধনী-গরিব বৈষম্য বৃদ্ধিতে, মানবাধিকার লঙ্ঘনে, অর্থ পাচার এবং ঋণখেলাপি বৃদ্ধিতে, এমনকি বিরোধী রাজনীতি দমনে। ক্ষমতার রাজনীতিতে এদেশে বিরোধী দল নিপীড়ন পুরোনো ধারা, সেই ধারায় আওয়ামী লীগ থেকে বেশি নিপীড়নে আর বেশি কে পড়েছে? তবে সর্বশেষ দুই মির্জা সাহেবকে মামলায় জড়িয়ে ফেলা দেশের মানুষ অবশ্যই সহজভাবে নেয়নি। তখন এমন কোনো অবস্থার সৃষ্টি হয়নি যে তাদের শ্রীঘরে ঢোকাতেই হবে। হয়তো বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনে তরতর করে বেড়ে ওঠা লতার মাথাটি ভেঙে দেওয়াই একটা কৌশল ছিল আওয়ামী লীগের। রাজনীতিতে এমনতরো অবস্থা আমরা তো হরহামেশাই দেখে আসছি এদেশে। সেনা-নিয়ন্ত্রিত এক-এগারোর সরকারও তো শেখ হাসিনাকে অযথা আটক করে রেখেছিল এবং পরে দৃশ্যত সমতা আনয়নে খালেদা জিয়াকেও তার (শেখ হাসিনার) প্রতিবেশী করেছিল সংসদ-চত্বরে। শেখ হাসিনা দৃঢ়তায় তা সামাল দিয়ে হিরো বনে গেলেন এবং ২০০৮-এর ডিসেম্বরের ভোটে বিপুল জনসমর্থনে আওয়ামী লীগের বিজয়ও এনে দিলেন। অবশ্য তার পরের আওয়ামী লীগ মেয়াদের দুই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে কট্টর সমালোচনা রয়েছে। ২০১৪ বিনা ভোটে অর্থাৎ ১৫৩/১৫৪ আসনেই বিনা ভোটে বিজয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ, আর ২০১৮-এ বলা হয়ে থাকে রাতের ভোটে। ফলে আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের জয়কে এভাবে চিহ্নিত করা যায়-২০০৮ ভোটে, ২০১৪ বিনা ভোটে এবং ২০১৮ ‘রাতের ভোটে’ বিজয়ী। যা হোক, দলটি তো দেশের উন্নয়ন করে দিচ্ছে, কর্তৃত্ববাদীই বলুন আর গণতন্ত্র সীমিতকারীই বলুন, মন্দের ভালো হিসাবে হলেও তো শেখ হাসিনাই আমাদের এখনো ভরসা, নয় কি?

গত ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা কেন যে বললেন, জনগণ বিজয়ী না করলে তিনি বা তারা জনগণের কাতারে চলে যাবেন-এটা আমার মাথায় এখনো ধরছে না। আমি অবশ্য বলি, আমার আবার মাথা-সেটা কী করে শেখ হাসিনার মতো পরিপক্ব বা তুলনামূলকভাবে ঝানু রাজনীতিকের বক্তব্য বুঝবে? আমার কেবলই মনে হয়, তিনি তো এখনো জনগণের কাতারেই রয়েছেন। জনগণের ভোটেই তো আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে। তাহলে এখন জনগণের কাতারে নেই বলার সুযোগ কোথায়? জনগণের কাতারে বলতে কি তিনি বিরোধী দলের কাতারে বোঝাতে চেয়েছেন? তাহলে কি ক্ষমতায় থাকলে অন্য কাতারে অর্থাৎ জনগণের কাতারের বাইরে বোঝানো হয়েছে? আমার তো মনে হয়, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকারে থাকলেই বরং জনগণের কাতারে থাকাটা বেশি প্রযোজ্য হয়, কারণ ক্ষমতায় থেকেই তো জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন বেশি করা যায়। এই যে প্রভূত উন্নয়ন হলো এবং হচ্ছে, এই যে স্যাটেলাইটযুগে আমরা প্রবেশ করলাম, এই যে মেট্রোরেল যুগে যেতে পারলাম, এই যে বঙ্গবন্ধু টানেলে যাব, এই যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছি, এই যে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে এগিয়ে যাব-এসব কি জনতার কাতারে অর্থাৎ ক্ষমতায় থেকে সম্ভব হয়নি? ক্ষমতায় না থাকলে কি এসব করা সম্ভব হতো? আর জনতার কাতারে থেকে ভোট না পেলে কি ক্ষমতায় আসা যেত? একটু এদিক-সেদিক, ভোটের হেরফের কোন দেশে না হয়? তারপরও তো ভোটেই ক্ষমতায়, তাহলে অবশ্যই এখনো আওয়ামী লীগ জনতার কাতারেই আছে-এ হচ্ছে আমার বিশ্লেষণ। বিরোধী দলে থাকলেই জনতার কাতারে থাকা হয়, আর ক্ষমতায় থাকলে তা নয়-এ আমার বিশ্বাস নয়।

অতএব শেখ হাসিনার ভাষণের এ বক্তব্যটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তবে উল্লেখ না করে পারছি না যে, ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার অপচেষ্টা অবশ্যই ঘৃণ্য এবং অগ্রহণযোগ্য তো বটেই। কিন্তু পেছনের দরজা দিয়ে যারা ক্ষমতায় আসে, তাদের পরে সমর্থন কারা দেয়-এদেশের রাজনীতিক বা রাজনৈতিক দল নয় কি? কারা জিয়া এবং এরশাদের, এমনকি পরে এক-এগারোর তিন-উদ্দিনের সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল? কারা বলেছিল, এ সরকার আমাদের আন্দোলনের ফসল? জিয়া-এরশাদের কি রাজনৈতিক দল ছিল, প্রথমে? পরে তাদের এত বড় দল হলো কাদের দিয়ে এবং কাদের সমর্থনে? আমি তাই বলি, এদেশের জনগণ নয়, এদেশের রাজনীতিকরাই পেছনের দরজায় ক্ষমতাগ্রহণকারীদের সবসময় ক্ষমতায় থাকতে সমর্থন দিয়ে থাকে, এমনকি ওইসব পেছনের দরজার ক্ষমতাধারীদের সঙ্গে ক্ষমতায়ও অংশগ্রহণ করে থাকে। অতএব তেমন কিছু, খোদা-নাখাস্তা, ভবিষ্যতে অপ্রত্যাশিতভাবে যদি ঘটেও, তাহলেও দেখা যাবে এদেশের রাজনীতিকরাই আবার পূর্ববৎ তাদের সমর্থনও দিচ্ছে এবং তাদের সঙ্গে হালুয়ারুটির ভাগও নিচ্ছে। নাম ধরে ধরে আগের উদাহরণ দেওয়ার আর কি প্রয়োজন আছে?

এবার আসি আরেকটি বক্তব্যে। এ বছরের পুলিশ সপ্তাহের ভাষণে শেখ হাসিনা বলেছেন, আগে পুলিশ শুনলে মানুষ ভয় পেত, এখন পুলিশ পাশে থাকে। তার এ বক্তব্য, আমার মতে, পূর্ণ সত্য নয়, আংশিক সত্য হতে পারে। এ আংশিক সত্যতা আগেও ছিল। হ্যাঁ, তবে আগে ভয় বেশি ছিল। তখন হাফ-প্যান্ট পরা পুলিশ দেখলে ভয়ে পালাতে গিয়ে নদী-পুকুরে পড়ে কেউ কেউ মারাও গেছেন। এখন কি তেমন মৃত্যু নেই? বরং এখন পুলিশের জনসম্পৃক্ততা যেমন বেড়েছে, নিষ্ঠুরতা আরও অনেক বেড়েছে। ভয় কমেছে পুলিশের জনমুখিতা এবং জনসম্পৃক্ততার কারণে। মাস্তান এবং দলীয় চেলাচামুণ্ডারা এখন পুলিশের ইউনিফরম পরা অবস্থায়ও কাঁধে এবং গায়ে হাত দিয়েও কথা বলে-যেন কতকালের দোস্তি! এটা কেন হয়, কেন হবে? অনেক সখ্য না থাকলে কার ঘাড়ে দুটি মাথা যে পুলিশের কাঁধে বা গায়ে হাত দিয়ে কথা বলে? পুলিশের নৈতিক অধঃপতন না ঘটলে কার এমন সাহস হয় যে, পুলিশকেও আক্রমণ করে, এমনকি মারেও? আমি সবসময় প্রো-পুলিশ এজন্য যে, পুলিশ আছে বলেই সমাজে নিরাপত্তা আছে এখনো, শৃঙ্খলা আছে এখনো। কিন্তু সমস্যা হলো, এ পুলিশের বেশকিছু কর্মকাণ্ড আমাদের হতাশ করে। পুলিশকে রাষ্ট্রীয় সেবক না হয়ে দলীয় লাঠিয়াল হওয়ার ভূমিকায় দেখলে আমরা যারপরনাই ব্যথিত হই। আর তখনই পুলিশকে মানুষ আর বন্ধু ভাবতে পারে না। আমার সবসময় কেন জানি মনে হয়, পুলিশ সত্যি সত্যি পুলিশের ভূমিকায় থাকলে তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা যেমন অনেক বেড়ে যেত, ভয়ও ততো কমে যেত। আর তার ফল হতো দেশের বর্তমান পরিস্থিতির খারাপ দিকটা অবিলম্বে ৭৫ শতাংশ কমে যেত, কারণ পুলিশের আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ দৃশ্যমান হয়ে গেলে কোনো অপরাধী আর ‘এদিক সেদিক’ করে পার পেয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই সাহস পেত না। এই ঘাটতি আছে বলেই তো এখন নিরপরাধ লোকও পুলিশকে ভয় পায়, আমিও পাই। তখন রুবেলকেও মনে পড়ে, জজ মিয়া তো এখনো জীবিতই আছে, মনে তো পড়বেই। সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পুলিশই কিন্তু এখনো আমাদের ভরসা। প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্যমতে মানুষ পুলিশকে ভয় পায় না কথাটি পূর্ণ সত্য নয়, পূর্ণ সত্য হচ্ছে ভয় পায়। উপায় নেই, পুলিশনির্ভর রাজনীতিতে পুলিশকে একটু সাধুবাদ না দিলে কি চলে? প্রধানমন্ত্রীকে তো সব দিক রক্ষা করেই রাজনীতি করতে হয়, নাকি?

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি