Loading..

উদ্ভাবনের গল্প

১৪ মার্চ, ২০২৩ ১১:১৪ অপরাহ্ণ

Greeting Board(গ্রেটিং বোর্ড)

আমি আমার বর্তমান কর্মস্থলে যোগদান করি ২০১৪ সালে।এর আগে অন্য বিদ্যালয়ে ছিলাম ৫ বছর।আমার দীর্ঘ ১৩ বছরে কর্মজীবনে দেখেছি,যখন কোন অভিভাবক একজন শিক্ষার্থীকে প্রাক প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেন তখন শিক্ষার্থীকে মনে হয় সে পৃথিবীর সবচাইতে অসহায় ব্যাক্তি।কারণ মায়ের কোল থেকে সে সবে মাত্র তার শিক্ষাজীবনে পা দেয়।বাড়ির পরিবেশ থেকে বিদ্যালয়ে এসে সে একটি নতুন পরিবেশের সম্মুখীন হয়।অনেকেই খুব অল্পতেই মানিয়ে নিতে পারলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই ক্লাসে মনোযোগী হতে সময় নেয়।আমি এমনও দেখেছি মা যখন শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষে বসিয়ে দেন তখনই সে কান্নাকাটি শুরু করে।কিছুতেই তাকে শ্রেণিকক্ষে ধরে রাখা সম্ভব হয় না।কখনো কখোনো মা বাধ্য হয়ে সন্তানকে বাড়িতে নিয়ে যান আবার কখোনো মা নিজেই পাশে বসে থাকেন সারাক্ষন।আবার এমন ও দেখেছি,যে শিশুটি বাড়িতে সব চাইতে চঞ্চল ও দুষ্ট সে বিদ্যালয়ে এসে কেমন যেন ঝিমিয়ে যায়,মন মরা হয়ে ক্লাসের এককোনে বসে থাকে।কোন কথা বললে উত্তর দিতে চায় না,বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করে না।এসব খুব ভাবাতো আমায়।আমি ভাবতে থাকি কি এর কারণ।শিক্ষকগণ আপ্রাণ চেষ্টা করেন তাদের ভালো রাখার জন্য,কত খেলাধুলা,গান,নাচ করে মাতিয়ে রাখেন পুরো ক্লাস।কিন্তু তারপরও কেউ কেউ বিদ্যালয়কে মনে করে একটা ভয়ংকর স্থান।ভেবে ভেবে আবিস্কার করলাম তাদের বিদ্যালয় ভীতির কারণ।মাত্র ৪ কিংবা ৫ বছরের একটা শিশু বিদ্যালয়ে যখন প্রথম দিন আসে তখন তার ধারনা হয় এটি একটি গুরুগম্ভীর স্থান,শিক্ষক মানেই ভিষণ গুরুগম্ভীর একজন ব্যাক্তি।তাই কারো কারো পরবর্তীতে এই ধারনা থেকে বের হতে সময় লাগে।একদিন এক বিদেশি বিদ্যালয়ের ভিডিও দেখছিলাম,দেখলাম তারা ক্লাসে প্রবেশের সাথে শিক্ষকের সাথে কুশল বিনিময় করছে।আমি সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিলাম,আমাকেও এমন কিছু ভাবতে হবে যাতে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের পূর্বেই শিক্ষার্থীদের সকল জড়তা কেটে যায়,শিক্ষককে তার খুব নিরাপদ ও বন্ধু মনে হয়।আমি প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করলাম।সকলে এই আইডিয়াটিকে গ্রহন করলেন।আমি কাজ শুরু করে দিলাম।বাজার থেকে একটি বোর্ড কিনলাম ।তাকে লিখলাম Greeting Board.এই বোর্ডে নিজ হাতে কিছু ছবি আকলাম।জুড়ে দিলাম সেই গ্রেটিং বোর্ডে।গাঢ় নীল রংগের বোর্ডটিকে কয়েকটি রংগীন ছবি দেখতে বেশ ভালো লাগছিল।পরেরদিন আমি খুব এক্সাইটেড ছিলাম,কারণ আমি এটি ওইদিন ব্যবহার করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।অনেক আশা আর উত্তেজনা নিয়ে এটি ঝুলিয়ে দিলাম প্রাক প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষের দরকার সামনে।শিক্ষার্থীদের বললাম,তোমাদের জন্য আমি একটা জিনিস এনেছি সবাই এটি দেখো তো।সবাই দেখলো।ছবি সমপর্কে জিজ্ঞেস করলে অনেকেই চমৎকার ভাবে উত্তর দিলো,আবার অনেকে নিশ্চুপ ছিল।সকলকে বললাম তোমরা তোমাদের ক্লাসে প্রবেশের আগে এখান থেকে যে কোন একটি ছবির উপর হাত রাখবে।এরপর দেখো আমি কি করি।শিশুরা একজন একজন করে আস্তে লাগলো আর একটা করে ছবিতে হাত দিয়ে স্পর্শ করছিল।আমি সেই ছবিগুলোর মত তাদের সামনে অভিনয় করে দেখাতে থাকি।যেমন কারো সাথে আমি হ্যান্ডশেক করি,কাউকে বুকে জড়িয়ে ধরি,কারো হাত ধরে নাচতে থাকি।একজন দুজনকে গ্রেটিং জানানোর এই পদ্ধতিটা দেখার পর বাকি শিক্ষার্থীরা এটি উপভোগ করতে থাকে।কারো মুখে তখন ভয়ের ছাপ নেই।সকলেই খুব সাচ্ছন্দে এগিয়ে আসছিল আমার কাছে।আর আমি প্রত্যেককে এই নতুন কোশলে গুড মর্নিং বলি,তারা ও আমাকে উত্তর দেয়।আমি মনে মনে খুব আনন্দিত হই।আমি ভাবতে থাকি ,আমি সফল হয়েছি।আমার শিক্ষার্থীরা আর আগের মত মন মরা করে বসে থাকে না,আগের মত কান্নাকাটি করে না।কারণ তারা প্রথম দিনই এই ভিন্ন পদ্ধতিতে অভ্যর্থনা গ্রহন করে তাদের বিদ্যালয় ও শিক্ষক সম্পর্কে যে পূর্বের ধারনা ছিল তা থেকে বেরিয়ে এসেছে।পরদিন থেকে এটি আমি নিয়মিত অনুশীলন করি।কখোনো যদি না করি তাহলে শিক্ষার্থীরাই ছুটে আসে,বলে ম্যাম আজ গুড মর্নিং বলবেন না? গত ২ বছর যাবৎ আমার বিদ্যালয়ে এভাবেই তাদের গুড মর্নিং জানিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করাই।আমি ছাড়া আমার বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকগণ ও এটি অনুসরন করেন।আমি মনেকরি বিদ্যালয়ের প্রতি ভীতি দুরীকরণে এবং শিক্ষকের প্রতি জড়তা কাটিয়ে ঊঠাতে এটি অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে।