Loading..

প্রকাশনা

০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০৮:০৬ পূর্বাহ্ণ

প্রযুক্তি

এআই নির্ভর টুল নির্মাণ এবং ল্যাংগুয়েজ মডেল ‘লামা টু’

চ্যাটজিপিটি আর গুগল বার্ড এর পর মার্ক জাকারবার্গ এর প্রতিষ্ঠান মেটা তৈরি করেছে ‘লামা’যার দ্বিতীয় সংস্করণ ‘লামা টু’ সম্প্রতি উন্মুক্ত হয়েছে।

কিন্ত ‘লামা টু’ (Llama 2) আসলে কীকীভাবে ব্যবহার করা যায় এই ল্যাংগুয়েজ মডেলবর্তমানে চ্যাট জিপিটির অত্যাধুনিক সংস্করণ ‘জিপিটি ফোর’ এর আধিপত্যের সময়ে ‘লামা টু’ কীভাবে কাজে লাগানো যাবে?

.

# ‘লামা টু’ আসলে কী?

২০২৩ সালের জুলাই মাসে ফেসবুকের মালিকানায় থাকা প্রতিষ্ঠান মেটা তাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের লার্জ ল্যাংগুয়েজ মডেল বাজারে ছাড়েযার নাম লামা টু।

লামা টু’ হচ্ছে একটি ‘ওপেন সোর্স’ বা উন্মুক্ত উৎস নির্ভর ল্যাংগুয়েজ মডেল। অর্থাৎএই ল্যাংগুয়েজ মডেলের কোড বা যেভাবে এই ল্যাংগুয়েজ মডেল তৈরি করা হয়েছেসেটা যে কেউ দেখতে পারেসংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারে এবং নিজেদের মত করে তৈরি করে নিতে পারে।

তুলনায় গুগল বার্ড কিংবা জিপিটি ফোর এর মত জনপ্রিয় ল্যাংগুয়েজ মডেল ওপেন সোর্স নয়। অর্থাৎলামা’র মত সেসব মডেলের গঠনের ব্যাপারে কেউ চাইলেও বিস্তারিত জানতে পারবে না।

মোটকথামেটা তাদের এই ল্যাংগুয়েজ মডেল সবার বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছে। তাই যে কেউ গবেষণা বা ব্যবসার কাজে এই মডেল ব্যবহার করতে পারে এবং এই প্রযুক্তির সুফল নিতে পারে।

তবে এই ল্যাংগুয়েজ মডেল ব্যবহার করে বড় কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বড় বাজেটের সফটওয়্যার নির্মাণ করতে চায়তাহলে মেটার অনুমতি নিতে হবে। এজন্যে ৭০০ মিলিয়নের চেয়ে বেশি ব্যবহারকারী আছেএমন প্রতিষ্ঠানের জন্যে ‘লামা টু’ ব্যবহারের আগে অনুমতি গ্রহণের নিয়ম রেখেছে মেটা।

মেটা কোম্পানির দ্বিতীয় প্রজন্মের এই ওপেন সোর্স লার্জ ল্যাংগুয়েজ মডেলের সাহায্যে চ্যাটজিপিটি অথবা গুগল বার্ড এর মত চ্যাটবট তৈরি করা সম্ভব। এই মডেলটিকে প্রচুর ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছেযাতে এটি মানুষের স্বাভাবিক ভাষার মত সামঞ্জস্যপূর্ণ আউটপুট বা ফলাফল দিতে পারে।

এ বছরের শুরুতে ‘লামা ওয়ান’ মডেল ছাড়া হয়। ‘লামা টু’ হচ্ছে সেই মডেলেরই উত্তরসূরী।

তবে প্রথম সংস্করণ হিসেবে ‘লামা ওয়ান’ কিন্তু ‘বিশেষভাবে গোপন’ রাখা হয়েছিল। কেবল অনুরোধের ভিত্তিতেই এটি ব্যবহার করা যেত।

অথচ নতুন ‘লামা টু’ মডেল গবেষণা বা ব্যবসা সম্পর্কিত কাজে ব্যবহারের স্বার্থে সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে এর উন্নয়নে মেটা ও মাইক্রোসফট একসাথে কাজ করেছে। তাই লামা টু এর তৈরি অ্যাপ্লিকেশন হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই উইন্ডোজ পিসি’তে দেখা যেতে পারে।

একই সঙ্গে ভবিষ্যতে চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কোয়ালকম এর তৈরি স্ন্যাপড্রাগন সিপিইউ নির্ভর ল্যাপটপ ও ফোনেও দেখা যেতে পারে এই ল্যাংগুয়েজ মডেলের ওপর নির্ভর করে তৈরি টুল ও অ্যাপস।

মেটা’র মতে, ‘লামা টু’কে এর আগের সংস্করণের তুলনায় ৪০% বেশি ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এর আদি মডেলের তুলনায় নতুন মডেলে কনটেক্স বা প্রসঙ্গের দৈর্ঘ্য দ্বিগুণ করা হয়েছে।

ফলে এমন একটি শক্তিশালী ও নির্ভুল ল্যাংগুয়েজ মডেল তৈরি করা সম্ভব হয়েছেযা মানুষের মত ভাষা ব্যবহার করতে পারে।

.

কী কাজে ব্যবহার করা হবে লামা টু?

এই লার্জ ল্যাংগুয়েজ মডেলটি বিভিন্ন ধরনের কাজে ব্যবহার করা যাবে। একে ঠিক চ্যাটজিপিটি এর সাথে তুলনা করা যায় না। বরং বলা যায়চ্যাটজিপিটি যেই ল্যাংগুয়েজ মডেল এর ওপর নির্ভর করে কাজ করেতেমনই একটি ল্যাংগুয়েজ মডেল হল ‘লামা টু’। লামা টু কাজে লাগিয়ে চ্যাটজিপিটি’র মত বিভিন্ন টুল ব্যবহার করা যাবে।

.

লামা টু কি বিনামূল্যে ব্যবহার করা যাবে?

এই ওপেন সোর্স ল্যাংগুয়েজ মডেল সবার ব্যবহারের জন্যে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। অর্থাৎলামা টু যে কেউ ব্যবহার করতে পারবেপরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারবে এবং একে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে অন্য সফটওয়্যার বা টুল তৈরি করতে পারবে।

সাধারণ ভোক্তারা লামা টু বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারলেও যেসব প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের সংখ্যা ৭০০ মিলিয়নের বেশিতাদেরকে এই মডেল ব্যবহার করার জন্যে কিছু সহজ শর্ত পূরণ করতে হবে।

.

লামা টু যেভাবে ডাউনলোড করতে হবে

লামা টু’ ল্যাংগুয়েজ মডেলের ওপর নির্ভর করে চ্যাটজিপিটি’র মত কোনো চ্যাটবট তৈরি করেনি মেটা। ফলে লামা টু নির্ভর কোনো চ্যাটবট এখনই ব্যবহার করতে পারছে না সাধারণ মানুষ।

লামা টু’ নামে ল্যাংগুয়েজ মডেলের ৩টি সংস্করণ উন্মুক্ত করেছে মেটা। এবং কেউ যদি কৌতূহলী হয় এবং লার্জ ল্যাংগুয়েজ মডেল নিয়ে কাজ করতে জানেতবে লামা টু এর ৩টি মডেলই ডাউনলোড করতে পারে। মেটা’র ওয়েবসাইটে এই মডেল তিনটি ডাউনলোড করার জন্যে উন্মুক্ত করে রাখা আছে।

তবে ‘লামা টু’ এর ওপর ভিত্তি করে চ্যাটবট তৈরি করেছে আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ‘হাগিং ফেইস’। তাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে যে কেউ লামা টু নির্ভর চ্যাটবট এর সাথে চ্যাট করতে পারে। লিংক: https://huggingface.co/meta-llama

হাগিং ফেইস’ এর প্ল্যাটফর্মে গেলে মূলত লামা টু নির্ভর চ্যাটবট এর পরীক্ষামূলক সংস্করণ বা ডেমো ভার্শন পাওয়া যাবে। তবে অন্যান্য চ্যাটবটের মত এখানেও একই ধরনের ইন্টারফেস ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে কেউ চ্যাটজিপিটি বা গুগল বার্ড ব্যবহার করলে ‘হাগিং ফেইস’ প্ল্যাটফর্মে থাকা লামা টু নির্ভর চ্যাটবটও ব্যবহার করতে পারবে।

চ্যাটবটের সঙ্গে চ্যাট করার জন্যে ইউজারকে শুধু টেক্সট বক্সে ‘প্রম্পট’ বা নির্দেশনা লিখে এন্টার দিতে হবে। তাহলেই চ্যাটবট ইউজারের নির্দেশনা বিশ্লেষণ করে তাকে এমন একটি রেসপন্স দেখাবেযেটা লামা টু এর প্রশিক্ষণের সময় ইনপুট দেয়া ডেটার ওপর ভিত্তি করে তৈরি।

.

লামা টু কি নিরাপদে ব্যবহার করা যাবে?

সহজ কথায়লামা টু হচ্ছে পূর্ব প্রশিক্ষিত ডেটাসেটযেটা মানুষের মত ভাষা ব্যবহার করে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। চ্যাটজিপিটি কিংবা গুগল বার্ড এর মত একই ধরনের চ্যাটবট তৈরি করার জন্য একে ব্যবহার করা যাবে।

সাধারণত এসব চ্যাটবটগুলি নিরাপদেই ব্যবহার করা যায়। তবে এসব চ্যাটবট প্রস্ততকারক কোম্পানি আপনার ডেটা এআই এর প্রশিক্ষণে ব্যবহার করতে পারে।

এছাড়া এসব চ্যাটবটে নির্দেশনা আকারে দেয়া ইউজারের তথ্য চুরি করার কিছু ঘটনার নজির আছে। সাধারণত এসব তথ্য থার্ড পার্টি বা তৃতীয় পক্ষের হ্যাকাররাই চুরি করে থাকে। তাই আপনাকে শনাক্ত করা সম্ভবএমন ব্যক্তিগত ডেটা চ্যাটবট এর সঙ্গে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকাই মঙ্গল।

.

লামা টু কতটুকু নির্ভুল?

লামা টু নির্ভর কোনো টুল কতটা সঠিক জবাব দিবেসেটা নির্ভর করে আপনি একে কী ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেনতার ওপর। একে প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় যে ডেটাসেট ব্যবহার করা হয়েছেসেটা বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের সঠিক উত্তরও ঠিক করে দিয়েছিল।

বর্তমানে দেখা যাচ্ছে গুগল বার্ডচ্যাটজিপিটি বা বিং চ্যাট এর মত সব টুলই কিছু সাধারণ প্রশ্নের অস্পষ্ট ও অশুদ্ধ জবাব দিচ্ছে। তবে কোডিং এর মত জটিল বিষয়ের ওপর করা সব প্রশ্নের উত্তর খুব সহজভাবেই দিতে পারছে। ধারণা করা যায়লামা টু নির্ভর চ্যাটবটও কোডিং এর মত বিশেষায়িত কাজে দক্ষ হবে।

.

লামা বনাম চ্যাটজিপিটি

মানুষের মত বুদ্ধিমত্তার সাথে প্রশ্নের জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে লামা এবং জিপিটিএই দুই লার্জ ল্যাংগুয়েজ মডেলই প্রযুক্তি জগতে বড় ধরনের বিপ্লব নিয়ে আসতে পারে।

এই মডেল দুটি প্রশ্ন অনুসারে প্রাসঙ্গিক এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতে সক্ষম। ফলে ভাষা সম্পর্কিত বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন নির্মাণে এ দুটি মডেল ভবিষ্যতে আরো বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হবে বলে ধারণা করা যায়।

এ দুটি মডেলের মূল শক্তির জায়গা এক হলেও কিছু বিষয়ে তফাৎ আছে।

যেমনমেটা এর তৈরি লামা এখনো এআই ভিত্তিক ল্যাংগুয়েজ মডেল এর জগতে নতুন মুখ। এর গঠনে সবচেয়ে জোর দেয়া হয়েছে দক্ষতা ও ন্যূনতম রিসোর্স এর চাহিদার ওপর। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই অনেকের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে।

লামা এর সবচেয়ে অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছেএটি অ-বাণিজ্যিক লাইসেন্স এর মাধ্যমে পাওয়া যায়। ফলে গবেষক ও প্রতিষ্ঠানগুলি খুব সহজে এই ল্যাংগুয়েজ মডেল তাদের কাজে লাগাতে পারবে।

অন্যদিকে ওপেনএআই এর তৈরি চ্যাটজিপিটি এর সুনাম রয়েছে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে অত্যাধুনিক জেনারেটিভ এআই সিস্টেম হিসেবে। মানুষের স্বাভাবিক ভাষার মত করে লেখা তৈরি করার অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি পুরো বিশ্বেই সমাদৃত।

তবে লামা আর চ্যাটজিপিটিএই দুই ল্যাংগুয়েজ মডেলের ভিত্তির মূলে আছে ‘ট্রান্সফর্মার’ নামের একটি পদ্ধতি।

সহজ কথায়ট্রান্সফর্মার হচ্ছে এক ধরনের কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কযা মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বিশাল বিশাল ডেটাসেট বিশ্লেষণ করতে পারে। একইসঙ্গে ট্রান্সফর্মার নিজের চিন্তা ও বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে অনুমান করতে পারে এবং নতুন কন্টেন্ট তৈরি করতে পারে।

.

যেভাবে দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে লামা

সফটওয়্যার ডেভেলপার প্ল্যাটফর্ম ‘রেপলিট’ এর প্রধান নির্বাহী আমজাদ মাসাদ বলেনবাণিজ্যিক কাজে লামা’র ব্যবহার অদূর ভবিষ্যতেই পুরো দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে।

তিনি যোগ করেনলামা’র মত ওপেন সোর্স মডেল ধীরে ধীরে যত উন্নত হবে তত ক্লোজ সোর্স মডেলের বাজার কমতে থাকবে। এর কারণ হচ্ছে ওপেন সোর্স মডেল আপনি সস্তায় চালাতে পারেন এবং এর ওপর আপনার নির্ভরতা কম থাকে।

উল্লেখ্যজিপিটি বা বার্ড হল ক্লোজ সোর্স মডেলের উদাহরণ। অর্থাৎবাণিজ্যিক কাজে এসব ল্যাংগুয়েজ মডেল বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায় না।

ক্লাউড ইন্ডাস্ট্রিতে মেটা’র তৈরি এই ল্যাংগুয়েজ মডেলের সাথে পাল্লা দিতে বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান নিজেদের মত করে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমনঅদূর ভবিষ্যতেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজে লাগানোর জন্য মাইক্রোসফট তাদের নির্মিত বিভিন্ন ধরনের এআই মডেল উন্মুক্ত করবে বলে জানিয়েছে। একাধিক সেসব এআই মডেলের মধ্য থেকে প্রতিষ্ঠানের সুবিধা অনুসারে মডেল বেছে নেয়ার সুযোগ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে মাইক্রোসফট।

আবার অ্যামাজন এখন ‘ক্লদ’ (Claude) নামের একটি এআই ল্যাংগুয়েজ মডেল উন্মুক্ত করেছে। তবে ক্লদ এখনো বেটা পর্যায়ে আছে। অর্থাৎএটি নির্মাণের কাজ এখনো শেষ হয়নি।

একইভাবে গুগল এর গ্রাহকরা যেন ‘ক্লদ’ এবং অন্যান্য মডেল সহজে ব্যবহার করতে পারেএমন পদক্ষেপ নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

সৌঃ সি বি

আরো দেখুন