Loading..

শিক্ষায় অগ্রযাত্রা

৩০ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১১:১১ পূর্বাহ্ণ

জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রেখেছেন যেসকল মুসলিম

জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রেখেছেন যেসকল মুসলিম

মুসলমানরা হাজারো আবিষ্কার বিশ্বকে উপহার দিয়েছে, যা ইতিহাসের চেহারা পাল্টে দিয়েছে এবং একটি বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ঘটিয়েছে। তবে আজ মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা থেকে পিছিয়ে আসার ফলে সে শূন্যস্থান দখল করে সামনে এগিয়ে এসেছে অন্যরা। দুঃখজনক সত্য হলো, মুসলিমদের রচিত আরবি গ্রন্থগুলো ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করা হলেও গ্রন্থকারের লাতিন নাম দেখে বোঝার উপায় নেই যে তাঁরা মুসলমান।

কয়েকজন মুসলিম বিজ্ঞানীর প্রাচীন ও আধুনিক নাম নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

১. আল খাওয়ারিজমি : পূর্ণ নাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমি।

তিনি ছিলেন পার্সিয়ান (ইরানি) মুসলমান বিজ্ঞানীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম একজন। তিনি একাধারে ভূগোলবিদ, জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ ও দার্শনিক ছিলেন। কিন্তু লাতিন ভাষায় তাঁর নাম এলগোরিজম (Algorism)।

২. ইবনে সিনা : পূর্ণ নাম আবু আলী আল-হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা।

তিনি একাধারে পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, ভূগোলবিদ, হাফিজ, যুক্তিবিদ, গণিতবিদ, কবি, ইসলামী চিন্তাবিদ ও মনোবিজ্ঞানী ছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর রচিত ১৬টি মৌলিক গ্রন্থের ১৫টিতে তিনি বিভিন্ন রোগের কারণ ও চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন।

কিন্তু যে গ্রন্থটি তাঁকে অমর করেছে তার নাম ‘কানুন ফি-তিব্ব’, যা ছিল পাঁচ খণ্ডে এবং ৮০০ পরিচ্ছেদে। ইউরোপে এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের বাইবেল (Bible of Medicine) নামে সর্বাধিক পরিচিত।

এ জন্য তাঁকে অনেকে চিকিৎসকদের চিকিৎসক (Doctor of doctors) বলে অভিহিত করেন। কিন্তু লাতিন ভাষায় তাঁর নাম অ্যাভিসিনা (Avicenna)।

৩. ইবনে বাজ্জাহ : পূর্ণ নাম আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে আস সাইগ আত তুজিবি ইবনে বাজ্জাহ আল তুজিবি। তিনি ছিলেন একাধারে জ্যোতির্বিদ, সংগীতজ্ঞ, পদার্থবিজ্ঞানী, চিকিৎসক, উদ্ভিদবিজ্ঞনী, কবি ও দার্শনিক। কিন্তু তাঁর লাতিন নাম অ্যাভামপেস (Avempace)।

৪. আল-ফরগানি : পূর্ণ নাম আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে কাসির আল-ফরগানি। নবম শতাব্দীতে তিনি ছিলেন বিশ্বের খ্যাতনামা একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। চাঁদের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ আলফ্রাগানুসের নামকরণ তাঁর নামেই করা হয়েছে। কিন্তু লাতিনে তাঁর নাম আলফ্রাগানাস (Alfraganus)।

৫. আল-ইদ্রিসি : পূর্ণ নাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রিস আল-শরিফ আল-ইদ্রিসি। পৃথিবীর প্রথম মানচিত্র অঙ্কনকারী। কিন্তু লাতিন ভাষায় তিনি দ্রেসেস (Dreses) নামে পরিচিত।

৬. আল-কিন্দি : কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইতিহাস, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ের বিশারদ আল-কিন্দির পুরো নাম আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল কিন্দি। যিনি আল-কিন্দি নামেই পরিচিত। কিন্তু লাতিন ভাষায় তাঁর নাম আলকিন্ডাস (Alkindus)।

৭. আল-বাত্তানি : সৌরবর্ষ নির্ণয়ে আল-বাত্তানী সর্বাধিক পরিচিত। পুরো নাম মুহাম্মদ ইবনে জাবির ইবনে সিনান আল রাক্কি আল হারানী আস সাবি আল-বাত্তানি। কিন্তু লাতিন ভাষায় তাঁর নাম আল-বাতেজনিয়াজ, আল বাতেজনি, আল-বাতেনিয়াজ ইত্যাদি।

৮. আল রাজি : আবু বকর মুহম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল রাজির নাম কে না জানে। তিনি একজন পার্সিয়ান পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, দার্শনিক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি প্রায় দুই শর মতো গ্রন্থ রচনা করেন, যার শখানেক চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে ‘আল জুদায়ী ওয়াল হাসবাহ’ নামক গ্রন্থটি। ইংরেজি ভাষায়ই ১৪৯৮ থেকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত এই গ্রন্থখানা মোট ৪০ বার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি কিতাব আল মনসুরি নামে ১০ খণ্ডে একটি বিরাট চিকিৎসাগ্রন্থও প্রণয়ন করেন। কিন্তু লাতিন ভাষায় তাঁর নাম রাজেস বা রাজিজ।

৯. ইবনে রুশদ: পুরো নাম আবুল ওয়ালিদ মুহম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে রুশদ। তিনি ইবনে রুশদ নামে বেশি পরিচিত। তিনি একজন আন্দালুসিয়ান (স্প্যানিশ) মুসলিম বিজ্ঞানী। তিনি একাধারে ইসলামিক দার্শনিক, ইসলামিক ধর্মতত্ত্ববিদ, যুক্তিবিদ, ভূগোলবিদ, জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ, পদার্থবিদ ছিলেন। কিন্তু লাতিন ভাষায় তাঁর নাম অ্যাভেরুশ (Averroes)।

১০. আল-জারক্বালি : আরব জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ আবু ইসহাক ইবরাহিম ইবনে ইয়াহিয়া আল নাক্কাস আল-জারক্বালি। তাঁর জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ছকের (Astronomical Table) জন্য পাশ্চাত্যে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর Book of Tables ত্রয়োদশ শতকে রাজা আল্ফোন্সোর (King Alfonso X) নির্দেশে অনূদিত হয় এবং এর মাধ্যমে পাশ্চাত্যে গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যার পুনর্জন্ম হয়। তিনি অ্যাস্ট্রোল্যাব যন্ত্রের উন্নতি সাধন করেন এবং বুধ গ্রহসংক্রান্ত টলেমির মতবাদে সংশোধনী আনেন। কিন্তু লাতিন ভাষায় তাঁর নাম মারজাকেল।

১১. আল-ফারাবি : দ্বিতীয় শিক্ষক খ্যাত প্রখ্যাত মুসলিম পদার্থবিজ্ঞানী, যুক্তিবিদ, মনোবিজ্ঞানী, দার্শনিক, সমাজবিদ, মহাকাশবিদ আবু নসর মুহম্মদ বিন মুহম্মদ আল ফারাবি। পদার্থবিজ্ঞানে তিনিই প্রথম ‘শূন্যতা’র অবস্থান প্রমাণ করেছিলেন। কিন্তু লাতিন ভাষায় তাঁর নাম আল ফারাবিয়াস।

১২. আল বলখি : পূর্ণ নাম জাফর ইবনে মুহম্মদ আবু মাশার আল বলখি। তিনি একজন বিখ্যাত পার্সিয়ান জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক, গণিতবিদ ছিলেন। তিনি আল ফালাকি, আবুল মাসার, ইবনে বলখি নামেও পরিচিত ছিলেন। কিন্তু লাতিন ভাষায় তাঁর নাম আল বুসার এবং আল বুক্সার।

১৩. হাসান ইবনে হাইছাম : আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক প্রখ্যাত পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিদ, প্রকৌশলী, গণিতবিদ, চিকিৎসাবিদ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ, দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী আবু আলী হাসান ইবনে হাসান ইবনে হাইছাম। তিনি বসরায় জন্মগ্রহণ করায় আল বাসরি নামেও পরিচিত। আলোকবিজ্ঞানে অসামান্য সংযোজন ‘কিতাবুল মানাজির’-এর ১৫-১৬ অধ্যায়ে জ্যোতির্বিদ্যার আলোচনা রেখেছেন। এ ছাড়া তাঁর ‘মিযান আল-হিকমাহ’ (Balance of Wisdom) এবং ‘মাকাল ফি দ্য আল-কামার’ (On the Light of the Moon) গ্রন্থদ্বয়ে তিনি সর্বপ্রথম গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যা ও পদার্থবিদ্যার সমন্বয় সাধনের চেষ্টা চালান। কিন্তু লাতিন ভাষায় তাঁর নাম আল হ্যাজেন (Alhayen)।

১৪. ইবনে তোফায়েল : পূর্ণ নাম আবু বকর মুহম্মদ ইবনে আব্দুল মালিক ইবনে মুহম্মদ ইবনে তোফায়েল আল কুসি আল আন্দালুসি। তিনি একজন মুসলিম লেখক, ঔপন্যাসিক, দার্শনিক, ইসলামিক ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন। কিন্তু লাতিন ভাষায় তাঁর নাম আবু বাসের।

১৫. আল বেরুনি : পূর্ণ নাম আবু আল-রায়হান মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আল-বেরুনি। তিনি জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, ইতিহাস, দর্শন, ‍ভূবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু লাতিন ভাষায় তাঁর নাম আলবেরোনিয়াস।

১৬. ইমাম গাজ্জালি : পঞ্চম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ তথা সংস্কারকারী। ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ তুসি আল-গাজ্জালি ছিলেন একাধারে একজন প্রভাবশালী ধর্মতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, আইনবিদ, যুক্তিবিদ মহাকাশবিদ, মনোবিজ্ঞানী। কিন্তু লাতিন ভাষায় তাঁর নাম আল গ্যাজেল।

শুধু ইবনে সিনা, খাওয়ারিজমি, ইবনে বাজ্জাহ, আল-ফরগানি কিংবা আল-ইদ্রিসি নন, বরং সব মুসলিম বিজ্ঞানীর নাম লাতিন ভাষায় অনুবাদ করে বিকৃত করা হয়েছে। তার পরও বিজ্ঞান যত দিন টিকে থাকবে মুসলিম বিজ্ঞানীরাও তত দিন ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন, ইনশাআল্লাহ।

news24bd.tv/ab

 

আরো দেখুন