Loading..

উদ্ভাবনের গল্প

০৪ মে, ২০২৪ ০২:৪১ অপরাহ্ণ

"আমরা করবো জয়, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু আর নয়”

"আমরা করবো জয়,

পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু আর নয়”


👉ভূমিকা

পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশ বিগত দশকে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার হ্রাস করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও এখনও এই বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDG) ২০৩০ - এর তুলনায় অনেক বেশি। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় যে, এই বয়সী শিশুদের মৃত্যুর বিভিন্ন কারণের মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হলো পানিতে ডুবে যাওয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার হ্রাস করার লক্ষ্যে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ করাকে একটি অন্যতম কৌশল হিসেবে নির্ধারণ করেছে।


👉বাংলাদেশে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সামগ্রিক চিত্রঃ

প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায়

১৯,০০০ মানুষের পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়। এর মধ্যে

১০,০০০ ৭৬% এরই বয়স ৫ বছরের কম। উল্লেখ্য, ১-৫ বছর বয়সী যেসব শিশুর মৃত্যু হয় তাদের মধ্যে ৫৮% মারা যায় পানিতে ডুবে। তাই পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করতে না পারলে বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে হ্রাস করা সম্ভব নয়।


👉বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর কারণসমূহঃ

১) যত্রতত্র উন্মুক্ত জলাশয়ের অবস্থানঃ ৮০% ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটে বাড়ির ২০ মিটারের মধ্যে। আবার পানিতে ডুবে যাওয়ার ৮০% ই ঘটে পুকুরে ও ডোবায়।

২) সচেতনতা ও তত্ত্বাবধানের অভাবঃ শিশুকে দেখাশোনা করার জন্য প্রাপ্তবয়স্ক কারো উপস্থিতি না থাকার কারণে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ৬৫%।

৩) দক্ষতার অভাবঃ

সাঁতারের কৌশলসমূহ জানা না থাকা, সঠিকভাবে পানি থেকে উদ্ধার ও উদ্ধার পরবর্তী প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কিত জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব।


👉প্রতিরোধে করণীয়ঃ

১) ঝুঁকি কমিয়ে আনাঃ খোলা জলাশয়ের চারপাশে শক্ত বেড়া দেওয়া ও ঘরের দরজায় প্রতিবন্ধক তৈরি করা যাতে শিশু ঘরের বাইরে যেতে না পারে।

২) সঠিকভাবে তত্ত্বাবধান করাঃ বাড়িতে সবসময় শিশুকে প্রাপ্ত বয়স্ক কারো তত্ত্বাবধানে রাখা এবং শিশুকে নিকটস্থ শিশুযত্ন কেন্দ্রে পাঠানো।

৩) সাঁতার শেখানোঃ

প্রশিক্ষিত ব্যক্তি বা প্রাপ্তবয়স্ক কারো সহায়তায় ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদেরকে সাঁতার শেখানো।


👉পানি থেকে শিশুকে উদ্ধারের পর-


🤚করণীয়ঃ

১) পানিতে ডুবে যাওয়া শিশুকে উদ্ধারের সাথে সাথে প্রশিক্ষিত ব্যক্তির (সনদপ্রাপ্ত) সাহায্যে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে।

২) প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পাঠাতে হবে।


🤚বর্জনীয়ঃ

১) মাথায় নিয়ে ঘুরানো যাবে না।

২) পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা করা যাবে না।

৩) ছাই বা লবণ দিয়ে শরীর ঢাকা যাবে না।

৪) বমি করানোর চেষ্টা করা যাবে না।


👉বাংলাদেশে শিশুদের পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধে কৌশলসমূহঃ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে বাংলাদেশে কার্যকর কৌশলসমূহ নিম্নরূপ:

১) ঘরের দরজায় প্রতিবন্ধক তৈরি করাঃ ঘরের দরজায় প্রতিবন্ধক তৈরি করা, যাতে ছোট শিশুরা একা একা ঘরের বাইরে যেতে না পারে।

২) শিশুর যত্নে কমিউনিটি ভিত্তিক শিশুযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করঃ বাংলাদেশে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শিশুরা সবচেয়ে বেশি পানিতে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। তাই এই সময়ে ১-৫ বছর বয়সী শিশুদেরকে কমিউনিটি ভিত্তিক শিশুযত্ন কেন্দ্রে রাখা গেলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সম্ভাবনা ৮০% কমে যায়।

৩) শিশুকে বাড়িতে বড়দের তত্ত্বাবধানে রাখাঃ বাংলাদেশে যত সংখ্যক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় তার মধ্যে ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, তারা প্রাপ্তবয়স্ক কারো তত্ত্বাবধানে ছিল না। এছাড়াও সব শিশুদের পক্ষে শিশুযত্ন। কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। তাই সবসময় শিশুরা যাতে বাড়িতে প্রাপ্তবয়স্কদের তত্ত্বাবধানে থাকে সে ব্যবস্থা করা।

৪) সাঁতার শেখানোঃ প্রশিক্ষিত ব্যক্তি বা প্রাপ্ত বয়স্ক কারো সহায়তায় ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদেরকে সাঁতার শেখানো। পুকুর, সুইমিং পুল, পোর্টেবল পুল- যে কোনো নিরাপদ স্থানেই সাঁতার শেখানো যেতে পারে। শিশু সাঁতার জানলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সম্ভাবনা ৯০% কমে যায়।

৫) প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করাঃ যে কোনো ধরনের ইনজুরিতে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে কমিউনিটির লোকজনের মধ্যে প্রাথমিক চিকিৎসা ও পানি থেকে উদ্ধারের কৌশল বিষয়ক জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা। এতে উদ্ধারকৃত শিশু বা ব্যক্তির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

৬) জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করাঃ কার্যকরী কৌশলসমূহ বাস্তবায়নে কমিউনিটির লোকজনকে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা। নিয়মিত কমিউনিটির লোকজন, শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গকে সঙ্গে নিয়ে সভা করা।


৭) শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ বিষয়ক মৃত্যু প্র কৌশলসমূহের অন্যান্য সুফলঃ পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধে বাস্তবায়িত কৌশলসমূহের অন্যান্য সুফল রয়েছে। যেমন,

১) শিশুদের অন্যান্য ইনজুরি থেকে রক্ষা করে।

২) কমিউনিটিভিত্তিক শিশুষত্ন কেন্দ্র ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশে সহায়তা করে।

৩) সাঁতার প্রশিক্ষণ শিশুদের নিয়মিত শরীরচর্চা করার প্রতি আগ্রহী করে তোলে।

৪) প্রশিক্ষিত প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানকারী (first responder) যে কোনো ধরনের চিকিৎসা সংক্রান্ত জরুরি সেবা ও ইনজুরিতে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে সক্ষম।

৫) পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুহার কমানোর মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDG) ২০৩০-এর একটি উদ্দেশ্য '৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার কমানো'- তে অবদান রাখতে পারে।


👉কমিউনিটিতে ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দায়-দায়িত্বঃ

১) অভিভাবকঃ শিশুদের পানির উৎস থেকে দূরে রাখতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া, সবসময় শিশুদের পূর্ণ তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করা, নিকটস্থ শিশুযত্ন কেন্দ্রে ভর্তি ও নিয়মিত অংশগ্রহণ করানো এবং ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষকের মাধ্যমে সাঁতার শেখানো।

২) কমিউনিটি পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিঃ পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ বিষয়ক কৌশলগুলো প্রচার করা, কমিউনিটিতে অন্যান্য মৃত্যুর সঙ্গে পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য সরকারি রেজিস্টারে সঠিকভাবে নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা করা।

৩) শিক্ষকঃ ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের সাঁতার শিখতে উৎসাহিত করা, অভিভাবক ও শিশুদের প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে উদ্বুদ্ধ করা, শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবধানসহ পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ বিষয়ক অন্যান্য কৌশলসমূহ প্রচার করা। প্রতি বছর ২৫ জুলাই বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস উদযাপন করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া।

৪) ধর্মীয় নেতাঃ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ বিষয়ক কার্যক্রম সম্পর্কে আলোচনা করা, কারো পানিতে ডুবে মৃত্যু হলে তার বিস্তারিত তথ্য সরকারি রেজিস্টারে নথিভুক্ত করতে উৎসাহিত করা।

৫) কমিউনিটি পর্যায়ের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মীঃ সেবাকেন্দ্রে, বিভিন্ন স্বাস্থ্য ক্যাম্পগুলোতে ও বাড়ি পরিদর্শনের সময় কমিউনিটির লোকজনদের মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করা।

৬) কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সদস্যঃ শিশুযত্ন কেন্দ্রগুলোতে সহায়তাকারী, সাঁতার প্রশিক্ষক এবং কমিউনিটিতে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানকারী (first responder) হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা ও সম্পৃক্ত থাকা। অন্যান্য সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করতে ক্লাবের মাসিক সভাগুলোতে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনা করা।

৭) স্থানীয় ক্লাবের সদস্যঃ এলাকায় পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ বিষয়ক কার্যক্রমসমূহ প্রচার করা এবং কমিউনিটিতে পানিতে ডুবে যাওয়াসহ অন্যান্য জরুরি চিকিৎসা সেবা ও ইনজুরিতে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানকারী (first responder) হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়া।