সিনিয়র শিক্ষক
২৮ জুন, ২০২০ ০৫:৫০ অপরাহ্ণ
সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি
ধরন: সাধারণ শিক্ষা
শ্রেণি: দশম
বিষয়: রচনাসম্ভার
ভূমিকাঃ সেই কত শতাব্দী আগে বড়– চন্ডীদাস বলে
গেছেন- “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।” সত্যিকার অর্থেও মানুষের
সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো সে মানুষ; সৃষ্টির সেরা জীব। যার মধ্যে আছে বুদ্ধি,
বিবেক, বিচার-বিবেচনা ও মানবতাবোধ। তবে এসব কিছু থাকা সত্ত্বেও মানুষ কখনো
কখনো তার মনুষ্য পরিচয় ভুলে যায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের বিভেদ সৃষ্টি
করে তারা রচনা করে নতুন নতুন কিছু পরিচয়। এরপর নিজ নিজ জাত, ধর্ম, বর্ণ ও
গোত্রকে সমুন্নত রাখতে, নিজেদের পরিচয়কে সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্টিত করতে শুরু
হয় দ্বন্দ্ব। জন্ম নেয় অন্যদের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা। আর এর থেকে
সৃষ্টি হয় সাম্প্রদায়িকতা। যার ফলে সহিংসতা ও যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর
এর থেকে মানুষকে সুপথে ফেরাতে পারে কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।
সাম্প্রদায়িকতা
কীঃ সাম্প্রদায়িকতা হলো সম্প্রদায়ভিত্তিক জাত্যভিমান। যখন একটি সম্প্রদায়
নিজেকে অন্যসব সম্প্রদায় কিংবা কোনো একটি বিশেষ সম্প্রদায় থেকে উৎকৃষ্ট মনে
করে, নিজেদের সবকিছুকে ভালো মনে করে, অন্য সম্প্রদায়কে নিকৃষ্ট কিংবা ছোট
মনে করে তখন সেই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে জন্ম নেয় সাম্প্রদায়িকতা।
সাম্প্রদায়িকতা হলো এমন একটি বোধ যা মানুষকে নিজেদের সাম্প্রদায়কে শ্রেষ্ঠ
ভাবতে শেখায় এবং সেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য সাম্প্রদায়ের প্রতি
বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের ক্ষতি করার জন্য,
তাদেরকে দমিয়ে রাখার জন্য, ধ্বংস করার জন্য মেতে ওঠে বর্বরতায়।
সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতিঃ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বলতে এক সাথে একই সমাজে বিভিন্ন
সম্প্রদায়ের মানুষের সহাবস্থানকে বোঝায়। সেখানে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে কোনো
জাত্যভিমান থাকে না। কেউ কাউকে ছোট ভাবে না। কেউ কাউকে বড় ও ভাবে না। কেউ
নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে না। কেউ কাউকে শত্রু হিসেবে গণ্য করে না। একই
সমাজ ও রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে সকলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
ধর্ম
ও সাম্প্রদায়িকতাঃ ধর্মের ভিত্তিতেই মানুষের পৃথক পৃথক সম্প্রদায় সবচেয়ে
বেশি গড়ে ওঠে। যেমন কেউ মুসলিম সম্প্রদায়ের আবার কেউ হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা
খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ। আবার একটি ধর্মের ভেতরেও আছে ভিন্ন ভিন্ন
বর্ণের মানুষ। যেমন মুলমানদের ক্ষেত্রে কেউ সুন্নি কেউবা শিয়া।
খ্রিস্টানদের মধ্যে কেউ ক্যাথলিক আবার কেউ প্রোটেস্ট্যান্ট। হিন্দুদের
মধ্যে কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয় আবার কেউবা শুদ্র। যদিও ধর্ম সম্প্রদায়
সৃষ্টি করে, তাই বলে ধর্ম কখনো কাউকে সাম্প্রদায়িক হতে বলে না। তাছাড়া ধর্ম
কখনো সাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থনও দেয় না। কারণ সকল ধর্মই মানুষকে শান্তি ও
সম্প্রীতির পথ দেখায়।
সম্প্রদায়িকতার কুফলঃ সাম্প্রদায়িকতা মানুষকে
এতই অন্ধ করে দেয়, বিচার বুদ্ধিহীন করে দেয় যে সুদীর্ঘকাল ধরে তিল তিল করে
গড়ে তোলা লোকালয়কে মুহূর্তের মধ্যে বিরাণ ভূমি বানিয়ে ফেলতে মানুষ
দ্বিধাবোধ করে না। সাম্প্রদায়িকতা কখনো কারো কোনো মঙ্গল করতে পারে না।
সাম্প্রদায়িকতা কেবল মাত্র মানুষে মানুষে হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, ক্রোধ,
মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি সৃষ্টি করতে পারে। এটা মানুষকে সংঘাত ও
সংঘর্ষে উৎসাহী করে তোলে। মানুষকে করে সহিংসতাপ্রেমী ও যুদ্ধবাজ।
সাম্প্রদায়িকতা মানুষকে বর্বর ও পাশবিক করে তোলে। মানুষের ভ্রাতৃত্ব ও
সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করে এই সাম্প্রদায়িকতা। ফলে জাতীয় জীবন স্থবির হয়ে পড়ে।
মানুষের সম্পদ ও প্রাণহানী ঘটে। সমাজে অরাজকতা ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়।
জাতীয় অগ্রগতি থমকে যায়।
সাম্প্রদায়িকতা বনাম একতাঃ সাম্প্রদায়িকতা
একটি সম্প্রদায়কে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কারণ সাম্প্রদায়িক চেতনা মানুষকে
ভাবতে শেখায় যে সে অন্যদের থেকে আলাদা। ফলে সম্পূর্ণ একা একটি সম্প্রদায়
জোর গলায় কিছু বলতে পারে না। কারো বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু বলতেও পারে না। একটি
দেশ ও দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য একতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি খুবই
ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, তাঁতি, ছুতার, মুচি
সবাই যখন এক হয়ে এক পতাকার নিচে এসে আপামর জনসাধারণ হিসেবে কাজ করে তখন
ব্যক্তির, সমাজের, দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়। মানুষ যখন
সাম্প্রদায়িকতাকে ভুলে একতাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকে তখন জীবন গতিময় হয়ে
ওঠে। ঐক্য বা একতা সবসময়ই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধাচরণ করে। যে দেশের মানুষ
সাম্প্রদায়িকতাকে বিশ্বাস না করে ঐক্যে বিশ্বাস করে তারাই উন্নয়ন ও
অগ্রগতির ধারায় সামিল হয়ে এগিয়ে যায়। ঐক্যের শক্তি দিয়ে তারাই
সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিরোধ করে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির
প্রয়োজনীয়তাঃ দেশ ও জাতি গঠনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অপরিহার্য একটি বিষয়।
একটি দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করতে পারে। কিন্তু তাদের মধ্যে
যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকে তাহলে তারা কখনোই একটি শক্তিশালী
জাতিতে পরিণত হতে পারে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির অভাবে সেই জাতির ভেতরে
অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এতে করে সমাজ ও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হলে সমাজ ব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
চারিদিকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ফলে অনিবার্যভাবেই যুদ্ধ ও সংঘাত দেখা দেয়।
মানুষে মানুষে আস্থার অভাব দেখা দেয়, অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়, সৌহার্দ্য ও
সহযোগিতার পথ বন্ধ হয়ে যায়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে দেশে গৃহযুদ্ধ
শুরু হয়ে যায়। ফলে ব্যাপক প্রাণহানী ঘটে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হয়। দেশের
নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এমন কি কখনো কখনো দেশের সার্বভৌমত্বও হুমকির মুখে
পড়ে। শুধুমাত্র একটি দেশের ভেতরেই নয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতি খুবই জরুরি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে গোটা বিশ্বই
সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিঃ বাংলাদেশ
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের সাথে কাঁধে
কাঁধ মিলিয়ে এক সাথে বাস করে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান। এটি আমাদের গৌরব
যে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ এক জাতি। আমরা বাঙালি জাতি, বাংলাদেশিরা খুব সচেতন
ভাবেই বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ
হই। সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও সহযোগিতা আমাদের আদর্শ। পারস্পরিক বিশ্বাস ও
আস্থা আমাদের ধর্ম। ৫২, ৬৯, ৭০, ৭১-এ বাঙালি জাতি তাদের অসম্প্রদায়িক
চেতনার স্বাক্ষর রেখেছে। তাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর একতাকে চিরভাস্বর
করেছে। মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, খাসিয়া, সাঁওতাল
নির্বিশেষে সকলে এক হয়ে যুদ্ধ করেছে। আমাদের প্রত্যেকটি উৎসবে বাঙালি জাতি
এক হয়ে যায়। পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজা, বড়দিন, বৌদ্ধপূর্ণিমা, বৈসাবি আর জাতীয়
দিবসগুলোতে সাম্প্রদায়িক পরিচয় ভুলে এক জাতি হিসেবে সকলে সমান অংশগ্রহণ
করে। কিন্তু এই সম্প্রীতির মধ্যেও কিছু কিছু ধর্মান্ধ মানুষের কারণে এই
দেশেও কখনো কখনো আঘাত হেনেছে সাম্প্রদায়িকতা। ’৯০-র দশকে ভারতের অযোধ্যায়
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ফলে এদেশেও দাঙ্গা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয়
নির্বাচন পরবর্তী সময়েও ঘটেছে কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা। কিন্তু তার পরেও
সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বে আমরা অসম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে পরিচিত।
বিশ্বে
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিঃ এক দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা কিংবা যুদ্ধ অন্য দেশকেও
প্রভাবিত করে। ফলে বিশ্বের শান্তি রক্ষায় ও প্রয়োজন সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতি। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ব পরিস্থিতি খুবই নাজুক। সবখানেই চলছে
হানা-হানি, মারামারি। ভারতের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক একটি দেশেও সংখ্যালঘুরা
ভুগছে নিরাপত্তাহীনতায়। মুজাফফরনগর দাঙ্গাই তার প্রমাণ। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধে হিটলার যে ইহুদি নিধনে নেমেছিল আজ তারাই ফিলিস্তিনি
মুসলমানদেরকে ধ্বংস করতে যুদ্ধে নেমেছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশে
চলছে সাম্প্রদায়িকতার নামে বর্বরতা। ইরাক, ইরানে শিয়া-সুন্নির সাম্প্রদায়িক
সংঘর্ষ রূপ নিয়েছিল যুদ্ধে। চীনে মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশের মুসলমানরা
সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে এখনো ঘোচেনি
সাদা-কালোর ব্যবধান। আফ্রিকার বর্ণবাদ তো সকলেরই জানা। ফলে বিশ্বে
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এখন খুবই কোনঠাসা অবস্থায় রয়েছে।
সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতি রক্ষায় করণীয়ঃ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি প্রতিষ্ঠা
করতে হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে রক্ষা করতে হবে। জাতিগত, বর্ণগত, ধর্মগত
বিভেদকে তুচ্ছ করে সকলের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনকে জোড়ালো করতে হবে। সকলের
প্রতি সযোগিতা, সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে পরস্পরের
প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস। রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক সকলের জন্য সমান
সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেন
সংখ্যালঘুরা নিরাপদভাবে, দ্বিধাহীন ভাবে সবকিছুতে অংশ নিতে পারে। সকলের
ভেতর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে। সরকার, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্র
ব্যবস্থাকে সংখ্যালঘুদের অনুকূল হতে হবে। ধর্মান্ধতা ত্যাগ করে মানুষের
প্রতি, অন্য ধর্মের প্রতি, সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বিশ্বাস
করতে হবে যে অন্য ধর্মের নিরীহ, নির্দোষ মানুষকে হত্যা করার নাম ‘জিহাদ’
বা ‘ক্রুসেড’ নয়। আর তা হলেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে।
উপসংহারঃ “জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে, সে
জাতির নাম মানুষ জাতি” কবির এই কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করলে কোনো মানুষের
পক্ষে সাম্প্রদায়িক হওয়া সম্ভব নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মানুষকে অন্যের
প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়। দৃষ্টিভঙ্গি উদার করে। মানুষকে ঐক্যে বিশ্বাস
করতে শেখায়। নিজের ধর্মের প্রতি যেমন বিশ্বাস জোরালো করে তেমনি অন্যের
ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা যাবে না এই বোধও তৈরি করে দেয়। সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতির কারণেই বহু সম্প্রদায় থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন জাতি শাক্তিশালী
জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।