Loading..

খবর-দার

০৬ জুলাই, ২০২০ ১০:১০ পূর্বাহ্ণ

সামাজিক অবক্ষয় ও আমাদের মূল্যবোধ

১.

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের মতো আমাদের বাংলাদেশও স্থবির হয়ে আছে। বন্ধ হয়ে আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অচল অবস্থায় রয়েছে অফিস, আদালত, কল-কারখানাসহ সব কিছু। আর এই স্থবিরতার কারণ করোনাভাইরাস। যার ফলে সরকারকে বাধ্য হয়ে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ও হচ্ছে সর্বস্তরের মানুষ। সবথেকে মানবেতর জীবনযাপন করছে নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন। এই সবকিছু বাইরেও প্রায় সকল স্তরের মানুষ জীবনযাপন করছে নিজে এবং নিজের পরিবারকে বাঁচানোর জন্য। সকলের মনোভাব এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আমি বাঁচতে পারলেই হবে।

কিন্তু এই সময়টা ছিল আমাদের নৈতিকতার পরিচয় দেয়ার। আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিজীবন ছেয়ে গেছে অনৈতিকতা ও আদর্শহীনতায়। মানুষের মৃত্যু যেমন এই সময়ে এসে আমাদের অনুভূতিকে নাড়া দেয় না, তেমনি কেউ না খেয়ে থাকলেও আমরা তাকে দেখতে যাই না। আবার যদিও বা যাই, এক কেজি চাল, আধা কেজি ডাল কাউকে দিলে একশত ছবি উঠিয়ে সমাজের কাছে নিজেকে মহৎ করার পৈশাচিক খেলায় মেতে উঠি।

২.
একটি রাষ্ট্রের, দেশের কিংবা সমাজের ভিত্তি হিসাবে ধরা হয় এই মূল্যবোধ বা নৈতিকতাকে, যা আমাদের মধ্যে এখন প্রায় বিলুপ্তের পথে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের এই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে নৈতিকতার পাঠ্যবইয়ে কিছু অধ্যায় ব্যতীত আর কোনো অস্তিত্ব বা গুরুত্ব আছে বলে মনে হয় না। সম্মানের সঙ্গে নীতির এবং নীতির সঙ্গে সামাজিক পরিস্থিতির একটা শক্তিশালী সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কটি যত দুর্বল হয়, নৈতিক অবক্ষয় তত মজবুত হয়।

একটি দেশের সরকার কখনোই আইন করে তার দেশের মানুষকে নৈতিকতার শিক্ষা দিতে পারবে না। একটা সময় ছিল যখন এই শিক্ষাটা পাওয়া যেত শিক্ষকদের কাছ থেকে। কিন্তু যে দেশে স্কুলের মেয়েরা প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হয় তাদের শিক্ষকদের কাছে। সেই শিক্ষকের কাছ থেকে নৈতিকতা শিক্ষা পাওয়ার আশা করা যায় না। তাই নিজে সচেতন হওয়া এবং নিজের পরিবার থেকে যদি এই শিক্ষা না পাওয়া যায় তাহলে বাংলার মানুষের কাছে নৈতিকতা কেবল একটি শব্দ হয়েই থাকবে।

অবক্ষয় শব্দের সার্বিক অর্থ বা আভিধানিক অর্থ ক্ষয়প্রাপ্ত। সততা, উদারতা, সৌজন্যবোধ, শিষ্টাচার, নিয়মানুবর্তিতা, নান্দনিক সৃজনশীলতা ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলী লোপ পাওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া কিংবা ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়াকে বলে সমাজিক অবক্ষয়। আর যার ফলে সমাজে খুন, ছিনতাই, মারামারি, মাদকাসক্ত তরুণ সমাজ ধর্ষণ, নারীদের গৃহে নির্যাতন ইত্যাদি ব্যাপারগুলোর পরিমাণ উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পায়। আমাদের সমাজ আজ এতটাই অবক্ষয়ে জর্জরিত যে, বিবেকের মৃত্যু ঘটেছে। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে অবক্ষয়ের অস্থিরতা।

৩.
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে নৃসংশভাবে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ তদন্তের মাধ্যমে জানা যায়, হত্যা করা হয় সামান্য মোবাইল ফোনের জন্য। যেখানে সে রমজান মাসের সেহেরি করার প্লেট হাতে নিয়ে ছিল। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রমজান মাস হচ্ছে সব থেকে পবিত্র মাস, যে মাস সকল ইসলাম প্রধান রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ মর্যাদার সাথে পালন করা হয়। সেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশ হয়েও সামান্য মোবাইল ফোনের জন্য সেহেরিরত এক শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে। এমন নজির আরও অনেক আছে, হয়ত তা সবাই জানতে পারি না। আমাদের মূল্যবোধ আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা নিয়ে চিন্তা করার সময় হয়েছে।

এছাড়াও মাত্র পৌনে এক ভরি স্বর্ণের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাঁচ ও ছয় বছর বয়সী দুই শিশুকে হত্যা করা হয়। নরসিংদীতে ছয়, আট ও দশ বছর বয়সী তিন ভাই-বোনকে হত্যা করে আপন ভাই। কুমিল্লায় হাত-পা বেঁধে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে পাষণ্ড স্বামীর বিরুদ্ধে। প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ায় নেত্রকোনার কেন্দুয়াতে এক কলেজছাত্রীকে কুপিয়ে জখম করে বখাটে এক ছেলে। একের পর এক হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিশেষ করে অসহায় শিশুদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলছে এই ভয়ঙ্কর নির্মমতা। ত্রাণের চাল দেয়ার নাম করে নয় বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি টঙ্গীতে সাত বছরের শিশুকে ধর্ষণ করা হয়। কিছু বুঝে উঠার আগেই সমাজের কঠিনতম সত্যের মুখোমুখি হয়েছে তারা। এছাড়াও গত বছরে ছয় মাসেই ৬৩০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয় আর ধর্ষণের পরে ৩৭ জনকে হত্যা করা হয়। রহস্যজনকভাবে ৪১ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

বর্তমান সমাজে ব্যক্তির মধ্যে নেতিবাচক দিকগুলো ফুটে উঠেছে। এর ফলে নিজে যেমন অন্যকে ধ্বংস করতে চায় তেমনি নিজেও এর শিকার হয়। আর শিশুরা এর ভুক্তভোগী হচ্ছে বেশি। এরা প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ কিছুই করতে পারে না। কারণ তারা দুর্বল। সমাজের 
বেশির ভাগ মানুষ যেখানে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে সেখানে এক শ্রেণির মানুষের চালের গুদামে পাওয়া যাচ্ছে সরকারের অনুদানের চাল। খাটের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল বিপুল পরিমাণ ভোজ্য তেল।

৪.
প্রবাদ আছে, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’। আমরা সময় কাটানোর জন্য বিভিন্ন ঘরোয়া খেলায় মেতেছি। কিন্তু খেলা দিয়ে তো সারাদিন কাটানো সম্ভব নয়। শয়তানের কাজ যেমন মানুষকে প্ররোচিত করে খারাপ কাজে লিপ্ত করা, ঠিক তেমনি অলসতায় মানুষ অনেক ধরনের কাজ করে ফেলে।

আমাদের মধ্যে হিংসার পরিমাণ এতটাই বেড়ে গেছে যে আমরা সামান্য লুডো খেলা নিয়েও দুই গ্রামের মধ্যে মারামারি বাধিয়ে দেই কিংবা সামান্য কোনো কারণেও আমরা নৃশংস হয়ে উঠি।

এই মহামারীকালে হাসপাতালে ভর্তি নেয়া হয়নি অনেক আক্রান্তদের। আক্রান্তদের অনেককেই বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয়নি নিজে আক্রান্ত হয়ে পড়ার ভয়ে। অনেক বিত্তবান লোকেরাও অর্থের বিনিময়ে তাদের জন্য ব্যবস্থা করতে পারেনি একটি সিট। অনেক প্রসূতিকেও ভর্তি করা হয়নি। মারা যাওয়ার পরেও অনেক এলাকাবাসী তাদের এলাকায় দাফন কাজ করতে দিচ্ছে না। অনেকের ভাগ্যে জুটছে না মসজিদে রাখা সেই শেষ আশ্রয়ের জায়গাটুকুও। অনেক সন্তান আবার করোনায় আক্রান্ত জন্মদাত্রীকে জঙ্গলে ফেলে আসছে। ছোট শিশুকে চোখের সামনে চিকিৎসার অভাবে মরতে দেখেছেন অনেক মা-বাবা।

আজকের তরুণ আগামী দিনের হাল ধরবে, দেশ রক্ষা করবে। কিন্তু তারাই এই দুঃসময়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। অথচ দেশ ও বিশ্বের এই চূড়ান্ত সময়ে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে তারাই। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তরুণ সমাজ হাল ধরেছিল বলেই আমরা এত দ্রুত স্বাধীন হতে পেরেছি। আজ মাদকের বিস্তার লাভের ফলে তরুণ সমাজ হারিয়ে ফেলছে নিজেদের সামান্য মানবিকতাটুকুও। তাদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে চরম হিংসা, জিঘাংসা ও মানসিক অস্থিরতা। মাদকের খরচের যোগান দিতে ছিনতাই এমনকি খুনের মতো জঘন্য কাজেও তাদের মানবিকতা নাড়া দেয় না। কিন্তু এ ধরনের পৈশাচিকতা কখনো কাম্য হতে পারে না।

৫.
আমাদের অবক্ষয়ের পরিমাণ এতটাই বেড়ে গেছে যে বর্তমান সময়ে এসে আমাদের দায়িত্ববোধ এবং দায়বদ্ধতা একেবারে শূন্যের কোঠায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে আমাদের মধ্যে সামঞ্জস্যতা একেবারে নেই বললেই চলে। যেই সময়ে অধিকাংশ মানুষের ঘরে নিত্য প্রয়োজনীয় খাবারটুকু নেই সেই জায়গায় অনেকে অগ্রিম দুই তিন মাসের খাবার কিনে বাজারের অস্থিরতা এবং কৃত্রিম অভাব তৈরি করছে। আর এই সুযোগে বাজারীরা নিত্য প্রয়োজনীয় খাবারের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে ফেলেছে। অনেক বিক্রেতা আবার অল্প পরিমাণ দ্রব্য বিক্রি করতে নারাজ। যার ফলে সামর্থ্য অনুযায়ী জিনিস কিনতে পারছে না সকলে।

আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়েও সামাজিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব না। প্রবাদে আছে, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা ঔষধ দেবো কোথা’। আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাও এইরকম হয়ে গেছে। আমাদের সকল ক্ষেত্রে অনৈতিকতা, অবক্ষয় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর এর থেকে পরিত্রাণের উপায় একটাই, পারিবারিকভাবে সচেতন হতে হবে। সাথে সাথে নিজেদেরও নিজেদের দায়বদ্ধতার বিষয়টা সর্বোচ্চ মর্যাদার সাথে পালন করতে হবে। ধর্মীয় বিধিনিষেধ যথাযথভাবে পালন করতে হবে। তাহলেই সামাজিক মূল্যবোধ যথাযথভাবে পালন সম্ভব হবে।

লেখক : শাহরীন তাবাসসুম, শিক্ষার্থী,  এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।