Loading..

পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি/ইমেজ

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১০:০৭ পূর্বাহ্ণ

আফিমের আদিকথা

পি গাছের নামকরণ করা হয়েছে গ্রীক পুরাণের ঘুমের দেবতা 'সোমনাস'-এর নামানুসারে। কারণ পপি ক্ষেতে বয়ে যাওয়া বাতাসও প্রাণীদের ঘুম পাড়িয়ে দিতে সক্ষম!প্রত্নতাত্ত্বিকরা নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের রান্নাঘরে পপি ফলের খোসার নিদর্শন পেয়েছেন। মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় লিপিতেও এর উল্লেখ রয়েছে। খাদ্য তৈরির উপাদান হিসেবে আমরা যে পোস্তদানা ব্যবহার করি, তা আসলে পপি ফলের ছোট ছোট বীজ!


পপি- একই সাথে বিখ্যাত এবং কুখ্যাত একটি গাছ। সুন্দর পপি ফুলের পাশাপাশি এ গাছ থেকে যেমন ওষুধ তৈরির নানা উপাদান পাওয়া যায়, তেমনি এ গাছের ফল থেকেই তৈরি হয় সর্বনাশা মাদক আফিম।

পপি গাছের কাঁচা ফলের খোসা কাটলে যে সাদা রস পাওয়া যায় তা ২৪ ঘণ্টা রোদে শুকালে পাওয়া যায় আফিম। এর রং তখন হয়ে যায় কালো বা কালচে বেগুনী। পপি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Papaver somniferum। এই নামকরণ করা হয়েছে গ্রীক পুরাণের ঘুমের দেবতা 'সোমনাস'-এর নামানুসারে। কারণ পপি ক্ষেতে বয়ে যাওয়া বাতাসও প্রাণীদের ঘুম পাড়িয়ে দিতে সক্ষম! বেদনানাশক হিসেবে মানুষ আফিমের ব্যবহার করে আসছে সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের রান্নাঘরে পপি ফলের খোসার নিদর্শন পেয়েছেন। তবে সম্ভবত নেশা করার জন্য নয়, বেদনানাশক হিসেবে এর কার্যকরিতার কথা জেনেই তখনকার মানুষ এটা ব্যবহার করত। মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় লিপিতেও এর উল্লেখ রয়েছে। হোমার (খ্রীষ্টপূর্ব ৯০০ সাল ) ও হিপোক্রেটিস (খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০ সাল) তাঁদের রচনাতে এর উল্লেখ করেছেন। রোমানদের থেকে আরবীয়রা, তাদের থেকে ভারত, চীন ইত্যাদি দেশে এর প্রচলন শুরু হয়। আফিমের চিকিত্‍সাগত ব্যবহারই একসময় ছিল প্রধান। ব্যথা কমানো, অনিদ্রা দূর করা, কাশি ও ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কাজে চলতো এর ব্যবহার। কিন্তু ধীরে ধীরে এর নেশা সৃষ্টির ক্ষমতাও প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর অপপ্রয়োগ শুরু হয়ে যায়।
খাদ্য তৈরির উপাদান হিসেবে আমরা যে পোস্তদানা ব্যবহার করি, তা আসলে পপি ফলের ছোট ছোট বীজ। এই পপি সিডও আবার দুই রকমের হয়- কালো আর সাদা। আমাদের দেশে সাদাটাই বেশী প্রচলিত। প্রতি ১০০ গ্রাম পোস্তদানায় থাকে ২১.৭ গ্রাম প্রোটিন, ১৯.৩ গ্রাম ফ্যাট, ১৫.৮৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম ইত্যাদি। তবে এতে আফিমের মতো আসক্তি সৃষ্টিকারী কোনো পদার্থ থাকে না, তাই নেশার সৃষ্টি করে না। নেশা সৃষ্টির উপাদান থাকে আসলে পপিফলের রসে। এর মধ্যে প্রধান হলো মরফিন। এটা থাকে শতকরা প্রায় ১০ ভাগ পরিমাণে। এছাড়া নোসকাপিন, প্যাপাভেরিন, কোডিন, থিবেইন ইত্যাদিও থাকে অল্প পরিমাণে। এগুলোও মাদকতার সৃষ্টি করে এবং অনেক কাশির ওষুধে মেশানো থাকে। আফিমের আসক্তি সৃষ্টিকারী ক্ষমতার মূলে রয়েছে মরফিন। ১৮০৩ সাল পর্যন্ত মিশ্র পদার্থ আফিমই ব্যবহার হতো। ১৮০৩ সালে ফ্রিডরিথ সার্টুইনার আফিম থেকে বিশুদ্ধ মরফিন বের করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তিনি জীবজন্তুর ওপর, নিজের ওপর এবং আরো তিনজন তরুণের ওপর মরফিন প্রয়োগ করে এর প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করেন। ঘুম পাড়ানো ও ব্যথা কমানোর ক্ষেত্রে এর প্রভাব লক্ষ্য করে তিনি এর নাম রাখেন মরফিন, গ্রীক পুরাণের ঘুমের দেবতা 'সোমনাস'-এর ছেলে 'মরফিউস'-এর নাম অনুসারে। বাবার ঘুম যাতে না ভাঙে, সেজন্য পাহারা দেয়ার কাজ করতেন মরফিউস। চিকিত্‍সাক্ষেত্রে বেশ কয়েক কাজে মরফিন ব্যবহার করা হতো। যেমন ব্যথা কমাতে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা হার্টফেল করার মতো অবস্থায় উদ্বেগ দূর করতে, ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে, অস্ত্রোপচারের আগে, কাশি কমাতে, অসুস্থ ব্যক্তির অতিরিক্ত শারীরিক চাঞ্চল্য দূর করতে, এমনকি কখনো কখনো মুমূর্ষু ব্যক্তির মনে আনন্দের ভাব জাগাতেও মরফিন ব্যবহার করা হতো। চিকিত্‍সার স্বার্থে রোগীর মনে আনন্দের ভাব জাগানোর জন্য মরফিন ব্যবহার করা হলেও চিকিত্‍সার স্বার্থ ছাড়া এই আনন্দ পাওয়ার বিপজ্জনক প্রবণতাই মরফিন ও এ জাতীয় মাদকের অপব্যবহারের মূলে রয়েছে। আর এতে খুব সহজেই ব্যক্তি আসক্ত হয়ে পড়ে। কোনো রোগীকে ৪ ঘণ্টা পর পর মরফিন দিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সে এর ওপর শারীরিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। মনের মধ্যে আনন্দের ভাব জাগায় বলে মানসিক নির্ভরশীলতাও চলে আসে। ফলে ধীরে ধীরে ব্যক্তি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তার জীবন, চিন্তা-চেতন, ব্যক্তিত্ব-মানসিকতা - সবকিছুই মাদক নির্ভর হয়ে পড়ে।
মরফিনের ওপর শারীরিক নির্ভরশীলতার কারণে এই মাদকটি ছাড়তে চাইলেও withdrawal symptoms এর তাত্‍ক্ষণিক যন্ত্রণার কারণে ছাড়াটাও অসম্ভব মনে হয়। একটানা মাদক গ্রহণ করার পর হঠাত্‍ তা বন্ধ করে দিলে কম বেশি শারীরিক কষ্ট দেখা দেয়। একেই withdrawal symptoms বলে। এই যন্ত্রণার ভয়াবহতার কারণে আসক্ত ব্যক্তি চেয়েও এ নেশা ছাড়তে পারে না। ফলে জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। মরফিন নেশা সৃষ্টির পাশাপাশি শরীরের ওপর অন্যান্য প্রভাবও ফেলে। যেমন ব্যথার অনুভূতি কমানো ও ঘুম পাড়িয়ে দেয়া, শ্বাস-প্রশ্বাস কমিয়ে দেয়া, অন্ত্রের সঞ্চালন কমিয়ে অন্ত্র থেকে জলশোষণ বাড়িয়ে বমির উদ্রেক করা, কোষ্ঠকাঠিন্য সৃষ্টি করা, চোখের মণি সংকুচিত করা, খিঁচুনি, যৌন ইচ্ছা ও ক্ষমতা হ্রাস করা, পিত্তথলির অভ্যন্তরীণ চাপ সৃষ্টি করা ইত্যাদি। এছাড়া ঘাম, গা চুলকানো, গায়ের রোম খাড়া হয়ে ওঠার মতো ব্যাপারও ঘটে।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি