সহকারী শিক্ষক
২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০৯:০৩ অপরাহ্ণ
সভ্যতার প্রধান এক প্রতীক চিহ্ন শূন্যের বিশালতা।
সম্মানিত প্যাডাগোজি রেটার মহোদয়, এডমিন প্যানেল মহোদয়, সেরা কন্টেন্ট নির্মাতাগন এবং শিক্ষক বাতায়নের সকল শিক্ষকদের প্রতি রইল আমার আন্তরিক সালাম ও শুভেচ্ছা।
আমরা প্রায় বলি শূন্য থেকে শুরু করা যাক কিন্তু শূন্য নিজে কবে,
কোথায়, কার হাত ধরে তার যাত্রা শুরু করেছিল,
তার স্পষ্ট এবং সর্বজনমান্য ইতিহাস আজও আমাদের অজানা।
0(শূন্য) হলো একাধারে একটি সংখ্যা এবং অঙ্ক। ইংরেজিতে জিরো (zero) শব্দটি এসেছে ভেনিশিয় শব্দ জিরো (zero) থেকে যা
আবার ইতালিয় জিফাইরো (zefiro জেফিরো) থেকে পরিবর্তিত হয়ে
এসেছিল। ইতালীয় জিফাইরো শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ "সাফাইর"
বা "সাফাইরা" (صفر) থেকে যার অর্থ "সেখানে কিছু ছিল না"।এই শব্দটি প্রথমে ভারতীয় সংস্কৃত শ্যুন্যোয়া
শব্দ হতে অনুদিত হয়েছে। সংস্কৃত শব্দ শ্যুন্যেয়া (শ্যূন্য) যার অর্থ খালি বা
ফাঁকা। ইংরেজি শব্দ জিরোর প্রথম ব্যবহার পাওয়া যায় ১৫৯৮ খ্রিষ্টাব্দে।
সভ্যতার প্রধান এক প্রতীকচিহ্ন শূন্য। ছোট্ট এই চিহ্নটি আমাদের দিয়েছে বড়
বড় গাণিতিক সংখ্যাকে অল্প কয়েকটি অঙ্কে প্রকাশ করার বা অতি জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে
গণিতকর্ম চালানোর সক্ষমতা। ১ প্রতীকটিকে দশ,একশ,এক হাজার কিংবা আরও অসংখ্য গাণিতিক সংখ্যায় রূপান্তরের ক্ষমতা আছে শুধু
শূন্যেরই। আমাদের গণিতব্যবস্থায় সংখ্যার প্রতিটি প্রতীকেরই আছে নিজস্ব একটি মূল্য।
পাশাপাশি তাদের অন্তর্গত অঙ্কগুলোর স্থানিক মূল্যও আছে। এ কারণে ১২৩৪ আর ৪৩২১ একই
প্রতীক দিয়ে লেখা হলেও এরা আলাদা দুটো সংখ্যা। কিছু-না বা শূন্যের কোনো প্রতীক
ছাড়া সংখ্যার এই কাঠামো গড়ে তোলা অসম্ভব ছিল।
শূন্যের ধারণা ৪০০০ - ৫০০০ বছর আগে সুমেরীয়রা প্রথম তাদের গণনা
ব্যবস্থায় শূন্যের প্রচলন করেন। কিন্তু তখন 0 না লিখে
সংখ্যার মাঝে খালি জায়গা রেখে দেয়া হতো পরবর্তীতে ব্যাবিলনীয়রা আরেকটু আপডেট
করেন। তারা খালি জায়গা না রেখে দুটি কোন আকৃতির জায়গা রাখলেন।
সমসাময়িক সময়ে মিশরীয় সভ্যতা অনেক এগিয়ে যাচ্ছিল তারা তখন
জ্যোতির্বিজ্ঞান, ক্যালেন্ডার তৈরি সহ নানা
জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছিল। নীলনদের ভাঙ্গনে হারিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ করতে
তারা আবিস্কার করল জ্যামিতি। যদিও সেটি জ্যামিতির
প্রাথমিক ধারনা ছিল, পরবর্তীতে তারা দের হাজার বছরের পুরনো পিরামিডের ঘনত্ব নির্ণয় করতে শিখলো, তারা ঘনবস্তুর ঘনত্ব নির্ণয় করতে শিখলো।
এরপর পন্ডিত ইউক্লিড কিছু স্বতঃসিদ্ধ নীতি বা মৌলিক নিয়ম এর উপর ভিত্তি
করে গণিতের আরেকটি শাখা প্রচলন করেন যেটি জ্যামিতি
নামে পরিচিত।
এত কিছু আবিষ্কারের মাঝে বারবার শুন্য এসেছিল কিন্তু শূন্যকে কেউ পাত্তা
দেয় নি, মিশরীয়রা শূন্যের বিরোধিতা করত তারা মনে করত
শূন্য মানেই ঈশ্বরের পরিপন্থী। তাই শূন্যের উপর তারা ঘোর বিরোধী, তাদের মতে শূন্য হলো শয়তানের সহচর তাই শূন্যকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা
করত মিশরীয়রা।
সেকালের গ্রিক পণ্ডিতেরা জ্ঞান চর্চা করার জন্য মিশরে যেত আর মিশরীয়রা
শূন্য কে অস্বীকার করতো অনেকটা দেখেও না দেখার ভান করত কিন্তু কখনো অত্যাচার করত
না কিন্তু গ্রিক পণ্ডিতেরা শূন্যকে রীতিমতো কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল ।
গ্রিক পন্ডিত পিথাগোরাস ছিলেন একটু অন্য তিনি আবার শূন্য এবং অমূলদ কথা শুনলে কঠিন
শাস্তি দিতেন তার মতো শূন্য হচ্ছে ঈশ্বরের পরিপন্থী আর অমুলোদ সংখ্যা হল বিশ্ব
প্রকৃতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী। পিথাগোরাস মিউজিক ভালোবাসতেন,
তিনি খেয়াল করেছিলেন বাদ্যযন্ত্রের তার গুলিতে যখনই মূলদ সংখ্যার
অনুপাতে টোকা দেওয়া হতো তখনই সুরেলা আওয়াজ হতো আর যখন অমুলদ সংখ্যার অনুপাতে
টোকা দেওয়া হতো তখন বেশুর আওয়াজ হত। এ থেকে পিথাগোরাস সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে
বিশ্ব সংসারে সবকিছুতে বিরাজ করছে মূলদ সংখ্যা।
মজার ঘটনা হচ্ছে পিথাগোরাসের এক হিপ্সাস নামক শিষ্য প্রথম অমূলদ সংখ্যার
অস্তিত্ব টের পেয়েছিল এবং তা প্রকাশ করতে গিয়ে তাকে স্বেচ্ছায় মৃত্যুদণ্ড নিতে
হয়েছিল। কিন্তু সত্য একদিন বেরিয়ে আসবেই পিথাগোরাস নিজেই অমূলদ সংখ্যার একটি
সুন্দর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন, গোল্ডেন রেশিও বা সোনালী
অনুপাত হচ্ছে সেই সুন্দর অস্তিত্ব। আসলে পৃথিবীতে অসংখ্য অমুলদ সংখ্যা। কিন্তু
পিথাগোরাস ছিলেন সেই সময় দেবতুল্য তিনি বলেছিলেন শূন্য এবং অমূলদ সংখ্যার
অস্থিত্ব নেই। যখন প্রমাণ পেলেন এর অস্তিত্ব রয়েছে তখন তিনি কোন মুখে তা আবার
প্রকাশ করবেন। তাই এদের অস্তিত্ব প্রমাণ পেয়ে খুব
সযত্নে গোপন রেখেছিলেন পিথাগোরাস এবং তার অনুসারীরা।
এই ছিল গ্রীক সভ্যতায় শূন্যের অবস্থান ।
এবার একটু পূর্বে আসি ভারতীয় উপমহাদেশে এই সময়ে শূন্য অসীম নিভৃতে বেশ
যত্নে ও মায়ায় বড় হচ্ছিল । কারণ ভারতীয়দের কাছে শূন্য মা ব্রক্ষার প্রতীক ৪৫৮
খ্রিস্টাব্দে হিন্দু ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ ঋকবেদে প্রথম শূণ্যের অস্থিত্ব লক্ষ্য
করা যায়। সংস্কৃতে একে শ্যুন্যেয়া বা খালি
হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। তাছাড়া বৌদ্ধধর্মে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মনকে খালি
করে ধ্যানে মনোনিবেশ করার কথা পাওয়া যায়। ভারতের গোয়ালিয়র এক মন্দিরের
শিলালিপিতে শূন্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তাছাড়া খ্রিস্টীয় ৩ থেকে ৪ শতকের মাঝে
লেখা বাকশালী পাণ্ডুলিপিতে শূন্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
তারও আগে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে হিন্দুরা
শূন্যকে সংখ্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ‘ছন্দসূত্রের’
রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ২০০। পিঙ্গল কর্তৃক এই রচনায় শূন্যের ব্যবহার
দৃষ্ট হয়। আর্যভট কর্তৃক বর্গমূল নির্ণয় পদ্ধতি দশমিক স্থানিক অঙ্কপাতন ও
শূন্যের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বৃহৎসংহিতা ও পঞ্চসিদ্ধান্তিকা প্রভৃতি গ্রন্থে
বরাহমিহির (খ্রিস্টাব্দ ৫০৫) বারবার শূন্যের উল্লেখ করেছেন। বরাহমিহিরের সমসাময়িক
জিনভদ্রতানির রচনায় শূন্যের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তিনি তাঁর রচনায় বৃহৎ বৃহৎ
সংখ্যা লেখার সময় একাধিক শূন্যের ব্যবহার করেছেন।
বর্তমানে শূন্যের যে প্রতীক ব্যবহৃত হয় প্রথমদিকে তা ছিল না। সে সময় এর
প্রতীক ছিল একটি বিন্দু [•]। শূন্যের প্রতীক কবে বিন্দু থেকে
ছোট বৃত্তের আকারে উন্নিত হয় তা অনুমানের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।
নানাঘাটে যে লিপি আবিষ্কৃত হয় তাতে সংখ্যা (দশ, কুড়ি
ইত্যাদি) প্রকাশের ক্ষেত্রে শূন্যের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। টলেমি তাঁর ‘অ্যালমাজেষ্ট’ গ্রন্থে শূন্যস্থানের জন্য গ্রিক বর্ণ
‘ওমিক্র্ন’ [০]ব্যবহার করেন। সপ্তম শতাব্দীতে
ভারতে ১, ২, ৩, ৪,...০ অঙ্ক সৃষ্ট লিখনপদ্ধতি মধ্যপ্রাচ্যের গণিতবিদ আল খোয়ারিজমি এবং আল
কিন্দির হাত ধরে ইউরোপে প্রবেশ করে। ইউরোপে দ্বাদশ শতাব্দী থেকে দশ অঙ্ক নিয়ে
গণনা শুরু হয়ে যায়। বিশ্বের মান্য গণিতজ্ঞরা সেই জন্য এগুলিকে ‘হিন্দু-আরাবিক নিউমেরালস’ বলেছেন। আলবেরুনি ভারত
ভ্রমণের সময়ে এক একটি প্রদেশে ১ থেকে ৯ প্ৰদেশভিত্তিক সংখ্যাচিহ্ন ও ০-র লিপির
উল্লেখ করেছেন।
এসব দেখলেই বুঝতে পারা যায় যে ভারতীয় উপমহাদেশে শূন্যের অবস্থান কতটা
ছিল।
এদিকে ধারনা করা হয় যে, দিগ্বিজয়ী গ্রিক
আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমন করলেন তখন তার
সৈন্য-সামন্ত এর মাধ্যমে ভারতীয়রা
ব্যাবিলনীয়দের গণনা শাস্ত্রের কথা কথা জানতে পারে।
ব্যাবিলনীয়রা শূন্য কে সংখ্যা হিসেবে না নিলেও তা কাজে লাগাচ্ছে সেটি এদের কাছ
থেকেই জানতে পারে।
এবার ভারতীয়রা শূন্যকে তাদের ১০ ভিক্তিক মালায় অবস্থান দিলেন আনুমানিক ৬২৮
খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মগুপ্ত নামক এক গণিতবিদ সর্বপ্রথম শূন্যকে সংখ্যা হিসেবে
ব্যবহার করেন তিনি শূন্য হিসেবে সংখ্যার নিচে বিন্দু চিহ্ন ব্যবহার করতেন। শূন্য
দিয়ে যোগ, বিয়োগ, গুন করেছিলেন
তিনি এবং তিনিই প্রথম শূন্যকে কোন সংখ্যা দ্বারা যোগ করলে সে সংখ্যাটি থাকে এবং
শূন্যকে কোন সংখ্যা দ্বারা গুণ করলে শূন্য থাকে সেটি প্রমাণ পেয়েছিলেন। কিন্তু
বিপত্তিটা করেছিলেন কোন সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করার ক্ষেত্রে, এখানে তিনি একটি ভুল করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন শূন্যকে কোন সংখ্যা দ্বারা
ভাগ করলে শূন্য পাওয়া যায়।
বারোশো শতাব্দীতে আরেক ভারতীয় গণিতবিদ দ্বিতীয় ভাস্কর্য প্রমাণ করেন কোন
সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে শূন্য নয় অসীম পাওয়া যায়।
অনেকে মনে করেন শূন্য কে প্রথম সংখ্যা আকারে রূপ দেন সেকালের জ্যোতির্বিদ
ভারতীয় গণিতবিদ আর্যভট্ট । আর্যভট্ট মাত্র ২৩ বছর বয়সে তার সেরা গ্রন্থ
আর্যভাটিয়া রচনা করেন। বইটি ছিল গ্রহ নক্ষত্র নিয়ে কিন্তু আর্যভট্টের
কাজে দশমিক সংখ্যা পদ্ধতির পূর্ণ ব্যবহার পাওয়া যায়। আর্যভট্ট অবশ্য তার কাজে
প্রচলিত ব্রাহ্মী লিপি ব্যবহার করেননি। তিনি সর্বপ্রথম জেনে-শুনে-বুঝে সংখ্যারেখায় মাঝখানে
শূন্যকে স্থান দিয়েছিলেন।
পরিশেষে বলা যায় যে , শূন্য সর্বপ্রথম কোন যুগে এবং কার মস্তিষ্ক এসেছিল তা পরিষ্কারভাবে বলা কঠিন । শূন্য একটি বাগানের ফুলের মতো কোন এক সকালে হটাত ফুটে উঠেনি বরং ধীরে ধীরে তার বিকাশ ঘটেছে। তবে শূন্যের আবিষ্কার যে ভারতবর্ষে হয়েছিল এ ব্যাপারে আজ আর দ্বিমত নেই।