Loading..

ম্যাগাজিন

০৭ ফেব্রুয়ারি , ২০২১ ১০:৪৫ অপরাহ্ণ

কালীদহ

কালীদহ

--

অসংখ্য কিংবদন্তী আর ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও তথ্যাবলীতে সমৃদ্ধ সুনামগঞ্জের ইতিহাস অতি প্রাচীন।

সেই সুনামগঞ্জে একটি নতুন পত্রিকার নামকরণ করা হয়েছে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতকে সামনে আনার জন্য,বর্তমান প্রজন্মকে চেনানোর জন্য,আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের অতীতের সাথে সংযুক্ত সেই চেতনাকে ধারণ ও লালন করার জন্য।

হ্যাঁ পত্রিকার নাম - কালীদহ।

কেন এই নাম? উত্তরটা আগেই দেয়ার চেষ্টা করেছি।

কী এই কালীদহ?

একটি গানের বন্দনা দিয়ে শুরু করি কালীদহের স্বরূপ অন্বেষণ।গান সুনামগঞ্জের প্রাণ,এখানে প্রাচীনকালে গানের সাথে বন্দনার রীতি প্রচলিত ছিল।

তারই একটি এরূপ

"

পূবেতে বন্দনা করি পূবে উদয় বানু

একদিকে উদয় গো ভানু,চৌদিকে পশর

পশ্চিমে বন্দনা করি,মক্কা ভালা স্থান

যে জাগায় জন্ম নিছে কিতাব,আর কোরাণ।।

উত্তরে বন্দনা করি হিমালয় পর্বত

যে জাগায় জন্ম নিছে মালামের পাথর

দক্ষিণে বন্দনা করি'কালীদহ'সাগর

যে জায়গায় বাণিজ্য করে চান্দ সদাগর"

অনুমান করা হয় সুনামগঞ্জ জেলার জেলার বেশিরভাগ অঞ্চল এককালে এই কালীদহ সাগরের নিচে ছিল।

এ কালীদহ সাগর সুনামগঞ্জ জেলার সমগ্র দক্ষিণাচল জুড়ে বিস্তৃত ছিল।

হাওর শব্দটি মূলতঃ সাগর (সায়র) শব্দটি থেকে এসেছে।

মনসা মঙ্গলে " কালীদয় সাগর" এর  উল্লেখ রয়েছে।

সুনামগঞ্জ কেন কালীদহ নামক সাগরের বুকে নিমজ্জিত ছিল এবং কালক্রমে তা পলিভরাট এবং ভূ-পরিবর্তনজনিত কারণে নিম্নভূমিতে পরিবর্তিত হয়েছে তার কয়েকটি ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা নিচে দেয়া হলো।

১।

সিলেটের তদানীন্তন কালেক্টর লিন্ডস এর অষ্টাদশ শতাব্দীতে লিখিত নিম্নরূপ একটি বর্ণনা পাওয়া যায়।

" In the Pre-historic days the southern part of the sadar Subdivision  and the northern part of Moulvibazar and Hobiganj Subdivisions and nearly the entire Sunamganj  Subdivision were a part of the Bay of Bangal or a large lake,along with the land of near by district Comilla,Mymensing,Dhaka & Noakhali.There are many proofs at the chinese travellar Heuen Sung in the seventh century A.D. has described the Sylhet area as Sihichot country on the sea shore.The famous saint Hazrat Shahjalal (R.H.) arrieved at Sylhet or Silhatta in 14th century A.D. It is said that nearly all the land from  sadarghat or Dinarpur of the Present Habiganj Subdivision upto Mona Rory's tilla in Sylhet was under deep water.

২।

সুনামগঞ্জের মাটিতে চুনাপাথর খনি ও কয়লা আবিস্কৃত হয়েছে।টেকেরঘাটে প্রাপ্ত চুনাপাথর এক ধরণের ক্যালসিয়াম যা সামুদ্রিক শামুক ও শৈবাল দ্বারা সৃষ্ট।

এ তথ্য কালীদহ সাগরের পক্ষে একটি বড় যুক্তি যে এককালে এখানে একটি সাগর ছিল,যার নাম কালীদহ।এই যুক্তি বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত।

৩।

সুনামগঞ্জে রয়েছে শত শত হাওর।এই হাওরগুলো কোথা থেকে এল? বর্ষায় সুনামগঞ্জকে এক বিশাল জলসমুদ্রে ভেসে থাকতে দেখা যায়।

এই জলসমুদ্র কোথা থেকে এল?

এই হাওরগুলোর গঠনপ্রকৃতি বিবেচনা করলে এ অনুমান করা যায় যে এই অঞ্চল কোনও এককালে একটি সাগরে নিমজ্জিত ছিল।

৪।

নিবন্ধের শুরুতে যে বন্দনা গান উল্লেখ করা হয়েছে তাতে দক্ষিণে যে বিশাল সাগরের কথা বলা হয়েছে তা এই অঞ্চলের ভূমির প্রাগ-ঐতিহাসিক অবস্থানের একটি ধারণা অনুমানের অবকাশ দেয়।

প্রায় সব ঐতিহাসিক এই অঞ্চল যে এককালে একটি সাগরের অংশ ছিল এবং সে সাগর যে কালীদহ সাগর তা চিহ্নিত করেছেন।

এই গানটি তার অন্যতম স্বাক্ষ্য দেয়।

৫।

প্রখ্যাত ভাষাতত্ববিদ শিব প্রসন্নলাহিড়ীর "সিলেটি ভাষাতত্বের ভূমিকা" বইতে সিলেটের হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঘব্রত নামে একটি পূজার উল্লেখ আছে।এই পূজায় কালীদহ সাগরের জলের উপর সাত গাছা দুর্বাসহ একটি মন্ত্রপাঠের কথা উল্লেখ আছে।এতে বোঝা যায় বৃহত্তর সিলেটের কোথাও কালীদহ সাগর নামে কোনও এককালে একটি সাগর ছিল।

৬।

হাওর শব্দটির মূল শব্দ সাগর।বর্যাকালে এ অঞ্চল সাগরের আকৃতি ধারণ করে।সুদূর অতীতে কালীদহ সাগর এর বিস্তৃতি বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ছিল বলে মনে করা হয়।

১০১১ খৃষ্টাব্দে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ জাহাজে চড়ে সরাসরি তাম্রলিপ্ত থেকে সিলেট পৌঁছে ছিলেন বলে তাঁর লিখনী থেকে জানা যায়।অনুমান করা হয় তিনি এ পথেই আবার চীন পৌঁছে ছিলেন।

তাঁর মতে নহরী আজরক নামে একটি নদী কামরূপের পাহাড় থেকে বেরিয়ে এসে হাবাঙ্গ শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, এ নদী দিয়ে বাংলা ও গৌড়ে যাওয়া যেত।বর্ণিত নদীটি প্রাচীন সুরমা বলে অনেকে অভিহিত করেছেন।

--- কালীদহের স্বরূপ অন্বেষণে হাতের কাছে নির্ভরযোগ্য তথ্যভাণ্ডার হিসেবে পেয়েছি শ্রদ্ধেয় লেখক আবু আলর সাজ্জাদ হোসাইন মহোদয়ের " সুনামগঞ্জ  জেলার ইতিহাস" নামক বইটি।

আমি বিনম্র কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি লেখক সমীপে।।

* এবং বিবিধঃ

----------

ভারতে বেদবাদী ও বেদবিরোধী মহান মানুষদের একটি সম্প্রদায় ছিল,দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে তাঁরা বলতেন মহামায়া। সেই মহামায়ার ছিল নানা বিভাজন। সম্পদ নিয়ে যে জনসাধারণ থাকতেন তাঁদের তাঁরা বলতেন লক্ষী। শিক্ষিত জনসাধারণকে বলা হত সরস্বতী। মধ্যবিত্ত জনসাধারণকে বলা হত দূর্গা। শ্রমজীবি জনসাধারণকে বলা হত কালী। কৃষিমজুরদের শ্যামা বলা হত। এঁরা সবাই মহামায়ার কন্যা,অর্থাৎ সমগ্র জনসাধারণের অংশ।

*

কালি শব্দটি বিভিন্ন অর্থ বহন করে। কালি- কল্য,আগামী দিন।

"কালি হৈতে যাইবে রাধা মথুরানগর"- শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। কালি- মসী " কালি,কলম মন লেখে তিনজন- প্রবচন। "চন্দ্রের হৃদয়ে কালি কলঙ্ক কেবল"- ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলী। কৃষ্ণবর্ণ,কাল,বিবর্ণ,মলিন

কালি- পিতলের শিঙ্গা,বাদ্যবিশেষ।

কালি- " কালিয়ে রুধিল গোবিন্দাই"- শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল। কালি- ক্ষেত্রে দৈর্ঘ ও প্রস্থের গুণফল,ইট,নিটন,নৌকস,পুষ্করিণী, গণনা হিসাব

"এবার কালী কু লইব, কালি কষে কালী বুঝে লব" -- রামপ্রসাদ।

কালীদহ-কালীহৃদ "দহ বুলী ঝাপ দিলো,সে মোর সুখাইল" গভীর দহ।

--কৃতজ্ঞতা:বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ,বঙ্গীয় শব্দকোষ।

*

সেই প্রাচীনকালের তথ্যপ্রবাহ বর্তমানে এসে পৌঁছেছে- কীভাবে? পদে পদে পদ্যরচনা হত,মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বর্ণনা,আশা,সুখ দুঃখ মানুষ ছন্দাকারে মুখে মুখে রচনা করত। প্রতিটি ভাষায় রচিত প্রাচীন কোন রচনা যা মুখে অথবা কলমে রচিত হত তা আদিতে মানুষ যা বিশ্বাস করত,যা ভাবত, যে জীবন যাপন করত তারই প্রকাশ। এভাবেই এক মহাকাল থেকে উত্থিত মহাইতিহাস এসে আরেক মহাকালে মিশে গেছে। আমাদের যদি খুঁজতে হয় নিজেকে তবে বর্তমানে দাড়িয়ে অতীতের দিকে ফিরে তাকাতেই হবে।অতীত ছাড়া বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ কোনটাই হয় না।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি