Loading..

শিক্ষায় অগ্রযাত্রা

১৫ ফেব্রুয়ারি , ২০২১ ০৫:৪৮ অপরাহ্ণ

সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের।

সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা মানুষকে উদারতা শেখায়, সবার সঙ্গে মিশতে শেখায়, সৃজনশীলতা তৈরি করে শিক্ষার্থীদের আনন্দে মাতিয়ে রাখে এবং সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার মতো কাজে তাদেরকে উজ্জীবিত করে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন শুধু পড়া, পরীক্ষা আর অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যা হারিয়ে গেছে সংস্কৃতি চর্চা। শিক্ষাঙ্গনে একসময় সংস্কৃচি চর্চা ও খেলাধুলার সুযোগ ছিল অবারিত। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে লেখাপড়ার পাশাপাশি নিয়মিত সংস্কৃতির নানা বিষয় ও খেলাধুলা চর্চা করতো নিয়মিত। বিদ্যালয়ের পাঠাগারের বই পড়ার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহিত্যচর্চার অভ্যাস গড়ে উঠত। বই পড়ার সংস্কৃতি নিজের মধ্যে গভীরতা তৈরি করে, ভাবতে শেখায়। নিয়মিত চর্চার এক পর্যায়ে প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বার্ষিক নাটক, আবৃত্তি, সঙ্গীত , বিতর্ক, অভিনয়, কিরাত প্রতিযোগিতা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো। হতো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। প্রকাশিত হতো বার্ষিক ম্যাগাজিন, দেয়াল-পত্রিকা। শিক্ষার্থীদের ক্রিয়টিভিটি প্রকাশ পেত এগুলোতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে।

প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচচ মাধ্যমিক স্তরের গতানুগতিক পড়ালেখা শেষ করে উচচশিক্ষায় প্রবেশ করে শিক্ষার্থীরা। এ পর্যায়ে মুখস্থবিদ্যা বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের এমান্বয়ে নিজেদের গবেষণাধর্মী শিক্ষাসহ নানা কাজে যুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু উল্টোভাবে চলছে দেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও পরীক্ষা ছাড়া বলতে গেল তেমন আর কিছুই হয় না এসব প্রতিষ্ঠানে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মতোই নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর শিখে পরীক্ষা দিতে হয়। শিক্ষার্থীদের আড্ডা দেয়া কিংবা গল্প করার মতো জায়গাও নেই। সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা আর বিতর্ক প্রতিযোগিতা হয় না বললেই চলে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নামমাত্র ক্লাব থাকলেও তাতে যুক্ত নেই দশশতাংশ শিক্ষার্থী। নিজস্ব ছাত্রবাস না থাকায় শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে বিভিন্ন স্থানে। বেশির ভাগ সময় কাটাচেছ ইন্টারনেট এমনকি অনেকে মাদকের পেছনেও ছুটছে। আর একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। আর সেটি হচেছ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে মানবিক বিষয়ের, বিজ্ঞানেরা কোন বিষয় পড়ানো হয়না হাতেগোনা দুএকটিতে ছাড়া। শুধু বিজনেস স্টাডি আর বিজনেস ম্যানজেমেন্ট। সবাইকে ব্যবসায়ী হতে শেখায়, মানবিক হতে না।মানবিক বিকাশের জন্য শিক্ষার্থীদের যে জায়গাটি ছিল এখন আর তা নেই। একজন শিক্ষার্থীকে ছবি আঁকা, নাচ-গান, হামদ-নাত, তেলাওয়াত, স্কাউটিং বা কোন চর্চার সাথে যুক্ত থাকতে হয়। সেটা না করে তারা হয়েছে এখন ক্যারিযারসর্বস্ব। তারা পড়ছে কিভাবে অর্থ উপাজর্ন করতে হবে এবং ব্যয় করতে হবে। জীবনের বিরাট এক অংশ তাদের অপূর্ন থেকে যাচেছ।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব, খেলাধুলার অভাব, যথাযথ শিক্ষার অভাব, আদর্শবাদী শিক্ষকের তদারকীর অভাব, সমাজে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ ও পরিবাবের মূল্যবোধ সম্পন্ন পিতামাতার অভাব-এতসব অভাব ও শূণ্যতার মাঝে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঢুকে গেছে উগ্রবাদিতা আর জঙ্গীকার্যক্রমের প্রতি ঝোঁক। আমাদের মাধ্যমিক ও উচচ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা তরুণ। এই বয়সে তারা নিজেদের কোন না কোন কাজে ব্যস্ত রাখতে, জড়িয়ে রাখতে চায়, নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। শিক্ষার্থীরা ভাল কাজের পরিবেশ পেলে নিজেদের ভাল কাজে জড়ায়, আর তা না হলে অন্যকাজে জড়াবেই। তারা শিল্প-সংস্কৃতির ছোয়া না পাওয়ায় জীবন ও জগতের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারছেনা। বই পড়ার আনন্দের মধ্যে নিজেকে জড়াতে না পারায় তারা নিজের মধ্যে আপন ভুবন তৈরি করতে পারছেনা। তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশও পরিপূর্নভাবে হচেছনা। এ কারনে সামান্য হতাশা কিংবা প্রলোভনের কাছে তারা হার মানে। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, দেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তিন কোটি ৬৮ লাখ ২ হাজার ১৮৭জন শিক্ষার্থী আছে। শুধু ক্লাসরুমে ক্লাস নিয়ে আর পাঠ্যবই পড়িয়ে দেশপ্রেম শেখানো যায়না, এর জন্য প্রয়োজন সংস্কৃতির মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের সঠিকভাবে গড়ে তোলা। ছেলেমেয়েরা মাদকে ঝুঁকছে, জঙ্গিবাদে ঝুঁকছে। কারণ তাদের আসলে বাইরের পরিস্থিতি মোকবিলা করার মতো যোগ্যতা তৈরি হয়নি।

এখন পড়ার সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে। টিভির চাকচিক্যের সংষ্কৃতি আর স্মার্টফোনের ব্যবহার, ফেসবুকে মাদকতা এখন আমাদের তরুণ সমাজকে গ্রাস করেছে। ভাবনার বদলে, প্রশ্ন করার বদলে তরুণরা এখন অনুকরনে আকৃষ্ট হচেছ। এই সুযোগে গণমুখী রাজনীতির অভাবটিও পূরণ করছে উগ্রবাদী রাজনীতি। এ অবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রে অনৈতিক উপার্জনের বিরুদ্ধে নৈতিকতা চর্চা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিকচর্চা জোরদার করতে হবে। শুধু অস্ত্র দিয়ে উগ্রবাদী তৎপরতা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। মানবিকতা তৈরির মাধ্যমেই উগ্রবাদী তৎপরতাকে মোকাবিলা করতে হবে। উগ্রবাদিতা প্রথম আসে মন থেকে , কাজেই মনকে প্রথম পরিশুদ্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত পরিবেশ থেকে আসে এই চিন্তা।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা হবে তখন চারদিকের পরিবেশও ভাল হবে। আমাদের দেশে উগ্রবাদিতার যথেষ্ট সুযোগ নেই কারন এখনকার মানুষ ধর্মের দিক দিয়ে উদার। কিছু কিছু মানুষের মধ্যে এটি হয়তো আছে কিন্তু সাধারনভাবে দেশের অধিকাংশ মানুষ উদার।

শিক্ষার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চা এখন গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। প্রকৃত মানব হিসেবে গড়ে ওঠার অপরিহার্য উপাদান হচেছ সংস্কৃতিচর্চা। লেখাপড়ার চাপ আর প্রতিযোগিতা ছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়াচর্চা না হওয়ার আর একটি কারন হচেছ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলার মাঠ না থাকা। যেসব প্রতিষ্ঠানে মাঠ নেই সেগুলোতে জাতীয় সংগীতও ঠিকমতো গাওয়া হয়না। অনেক প্রতিষ্ঠানে মাইকে জাতীয় স্গংীত বাজানো হয়, শিক্ষার্থীদের কন্ঠও মেলাতে হয়না। জাতীয় সঙ্গীত যখন বাজানো হয় এবং শিক্ষার্থীরা যদি মন দিয়ে তা গায় তাহলে তাদের মনে আলাদা এক ধরনের অনুভূতি, আলাদা এক ধরনের দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি অনুসারে পড়াশোনার চাপ এতবেশি যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রুটিন শেষ করতেই হিমশিম খাচেছ। সারা বছর ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চার কোন সুযোগই নেই। শহরের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরে একবার ক্রীড়া-সাংষ্কৃতিক সপ্তাহ পালিত হয়। এর মধ্যেই যতটা সম্ভব প্রতিযোগিতা করে পুরুস্কার দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত শহরের স্কুল কলেজে খেলার মাঠ নেই, কারন জমি নেই কিন্তু জনসংখ্যার চাহিদার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচেছ। এসব প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড কিভাবে চালানো যায়, খেলাধুলার ব্যবস্থা কিভাবে করা যায় তা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবার সময় এসেছে।

আমারা ছেলেমেয়েদের বাধবাধকতার সঙ্গে গড়ে তুলি। এটা করোনা, ওটা করোনা। এর ফলে তারা নিজেদের মতো করে তৈরি হয়না। তৈরি হয় আমাদের অভিভাবকত্ব দিয়ে, অনুশাসনের মাধ্যমে। এটা তাদের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি সমাজের জন্য । কারন সে সমাজের মতো করে তৈরি হয়না। ছেলেমেয়েরা যখন বাইরে যায় তারা সেখানে নিজেদের সেভাবে মানিয়ে নিতে পারেনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ’ যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল তাহারই মধ্যে কারাুরদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নহে। আমরা কিয়ৎ পরিমাণে আবশ্যকশৃংখলে বন্ধ হইয়া থাকি এবং কিয়ৎ পরিমাণ স্বাধীন। আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বন্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিনহাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলেনা। স্বাধীন চলাচলের জন্য অনেকখানি স্থান রাখা অত্যাবশ্যক। নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য এবং আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য কিন্তু আমরা তা বুঝব কবে?

ফয়সল আহমদ

সহকারি শিক্ষক (বিজ্ঞান)

লক্ষণাবন্দ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি