Loading..

পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি/ইমেজ

২৩ ফেব্রুয়ারি , ২০২১ ১০:৫৩ অপরাহ্ণ

ফাগুনের এ লগনে প্রকৃতির নতুন সাজ

কবির ভাষায়- ‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত’। কিন্তু আজ ফুল ফুটেছে আর জানান দিয়েছে বসন্ত ঋতু আমাদের মাঝে হাজির। প্রকৃতি আজ দক্ষিণা দুয়ার খুলে দিয়েছে আর সে দুয়ারে বইছে ফাগুনের হাওয়া। বসন্তের আগমনে কোকিল গাইছে গান। ভ্রমরও করছে খেলা। গাছে গাছে পলাশ আর শিমুলের মেলা। আজ পহেলা ফাল্গুন। ফাল্গুনের হাত ধরেই ঋতুরাজ বসন্তের আগমন। ঋতুরাজকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতির আজ এত বর্ণিল সাজ। বসন্তের এই আগমনে প্রকৃতির সঙ্গে তরুণ হৃদয়েও লেগেছে দোলা। সব কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে বিভেদ ভুলে নতুন কিছুর প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা নিয়ে বসন্তের উপস্থিতি। ফাগুনের মাতাল হাওয়া দোলা দিয়েছে বাংলার নিস্বর্গ প্রকৃতিতে। নতুন রূপে প্রকৃতিকে সাজাবে ঋতুরাজ বসন্ত। ফুলেল বসন্ত, মধুময় বসন্ত, যৌবনের উদ্দামতা বয়ে আনার বসন্ত আর আনন্দ, উচ্ছ্বাস ও উদ্বেলতায় মনপ্রাণ কেড়ে নেয়ার আজ প্রথম দিন। ফাগুনের আগুন যে মনে ধরছে তা প্রকৃতির চিত্রপটেই বোঝা যাচ্ছে।

মৃদু মৃদু বাতাস শীতের রুক্ষতা দূর করে মনকে উদাস করে দিচ্ছে। বছর ঘুরে আবারও ফাল্গুনের দেখা। ষড় ঋতুর বাংলায় বসন্তের রাজত্ব একেবারে প্রকৃত সিদ্ধ। ঋতুরাজ বসন্তের বর্ণনা কোনো রংতুলির আঁচড়ে শেষ হয় না। কোনো কবি-সাহিত্যিক বসন্তের রূপের বর্ণনায় নিজেকে তৃপ্ত করতে পারেন না। তবুও বসন্ত বন্দনায় প্রকৃতিপ্রেমীদের চেষ্টার যেন অন্ত থাকে না। ফাগুনের আগুনে, মন রাঙিয়ে বাঙালি তার দীপ্ত চেতনায় উজ্জীবিত হবে।

বাঙালির ইতিহাস আবেগের। এ আবেগ যেমন মানুষে মানুষে, তেমনি মানুষের সঙ্গে প্রকৃতিরও বটে। দিনক্ষণ গুনে গুনে বসন্ত বরণের অপেক্ষায় থাকে বাঙালি। কালের পরিক্রমায় বসন্ত বরণ আজ বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উৎসব। আবাল-বৃদ্ধ, তরুণ-তরুণী বসন্ত উন্মাদনায় আজকে মেতে উঠবে। শীতকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়েই বসন্ত বরণে চলবে ধুম আয়োজন। শীত চলে যাবে রিক্ত হস্তে, আর বসন্ত আসবে ফুলের ডালা সাজিয়ে। বাসন্তী ফুলের পরশ আর সৌরভে কেটে যাবে শীতের জরা-জীর্ণতা। বসন্তকে সামনে রেখে গ্রাম বাংলায় মেলা, সার্কাসসহ নানা বাঙালি আয়োজনের সমারোহ থাকবে। ভালোবাসার মানুষরা মন রাঙাবে বাসন্তী রঙেই। শীতের সঙ্গে তুলনা করে চলে বসন্তকালের পিঠা উৎসবও।

প্রাচীন আমল থেকেই বাংলার এই অঞ্চলে বসন্ত উৎসব পালিত হচ্ছে। এই বিষয়ে ইতিহাসবিদ ও গবেষকগণের মতামত এই যে- ভারতবর্ষে বসন্ত উৎসবের ইতিহাস বেশ পুরনো। হিন্দুদের পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলোতেও এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। হিন্দু বৈষ্ণবরা এ উৎসব বেশ আয়োজন করে পালন করে থাকেন। আর এই উৎসব বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- দোল, দোলপূর্ণিমা, হোলি। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনি পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীদের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। অবশ্য শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্ত উৎসব পালনের রীতি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে।

পহেলা ফাল্গুন বা বসন্ত উৎসব কেবল উৎসবে মেতে ওঠার সময় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য, বাঙালিসত্তা। সে ঐতিহ্যের ইতিহাসকে ধরে রাখতে পারলেই বসন্ত উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্ম ছড়িয়ে দিতে পারবে বাঙালি চেতনাকে। বসন্ত শুধু অশোক-পলাশ-শিমুলেই উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায় না, আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্ত রঙিন পুষ্পিত রক্তের স্মৃতির উপরও রং ছড়ায়। ১৯৫২ সালের আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ার যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বাংলা পঞ্জিকা বর্ষের শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম দিনকে বাঙালি পালন করে ‘পহেলা ফাল্গুন-বসন্ত উৎসব’ হিসেবে। বাঙালির নিজস্ব সার্বজনীন প্রাণের এ উৎসব এখন গোটা বাঙালির কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। বাংলায় বসন্ত উৎসব এখন প্রাণের উৎসবে পরিণত হলেও এর শুরুর একটা ঐতিহ্যময় ইতিহাস আছে, যা অনেকের অজানা। মোগল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালে। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসন্ত উৎসব। তখন অবশ্য ঋতুর নাম এবং উৎসবের ধরনটা এখনকার মতো ছিল না। তখনকার আর এখনকার ফাল্গুনের এই উৎসব একদম ভিন্ন। গ্রামে গ্রামে যে আয়োজন হতো তাতে আতিসাজ্যের কোনো সুযোগ ছিল না। আর এখন, সব আয়োজনে খাবার থেকে বিনোদন পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে বড্ড বাড়াবাড়ি রকমের লোকদেখানো। মমতা মাখানো মা খালাদের পিঠা পুলি পরিবেশনা যেখানে গ্রামের সব বয়সী শিশুদের অবাধ নিমন্ত্রণ সেই উৎসব এখন বইয়ের পাতাতেও পাওয়া যাবে না। কালের বিবর্তনে আমরা আধুনিক হয়েছি ঠিকই কিন্তু আমাদের বাঙালি সত্বা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।

শীতের খোলসে ঢুকে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্গম এখন অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠেছে। মৃদুমন্দা বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধে বসন্ত জানিয়ে দিচ্ছে, সত্যি সত্যি সে ঋতুর রাজা। লাল আর হলুদের বাসন্তী রঙে প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের সাজিয়ে আজ বসন্তের উচ্ছলতা ও উন্মাদনায় ভাসবে বাঙালি। তরুণীরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে প্রকৃতির কোলে নিজেকে সপে দিতে চাইবে। অপরদিকে বসন্তের উদাস হাওয়ায় তরুণেরা নিজেকে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে প্রকৃতির মন কাড়তে চাইবে। বসন্ত যেন মানব মন আর প্রকৃতির রূপ প্রকাশের লীলা-খেলা।

বাংলাদেশে বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে। এছাড়া তরুণ-তরুণীরা বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শাহবাগ, চারুকলা চত্বর, পাবলিক লাইব্রেরি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ধানমণ্ডি লেক, বলধা গার্ডেনসহ নানা জায়গায় আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নেয় সারাদিন। বসন্তের আগমনে নব উদ্যমে জেগে উঠুক বাঙালির প্রাণ।

 

আরো দেখুন