Loading..

ম্যাগাজিন

১০ মার্চ, ২০২১ ০৯:৩৪ অপরাহ্ণ

ভ্রমণ

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর

---নাসরীন আক্তার খানম

বলা হয় ধানের দেশ, গানের দেশ সুনামগঞ্জ। এখানে অনেক মরমী কবি গায়কের জন্ম হয়েছে। প্রত্যন্ত এই জেলাটি প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যে ভরপুর। সারাবছরই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা এ জেলায় ভ্রমণ করে থাকেন। বর্ষায় একরম সৌন্দর্য, শুকনো মৌসুমে আরেক রকম। সুনামগঞ্জের সীমান্ত ঘেষা তাহিরপুর উপজেলা যেন প্রকৃতির সাজানো ডালি নিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সৌন্দর্য ও সম্পদে পরিপূর্ণ এ উপজেলায় দেখে নিই কী কী আছে দেখার মত:

লাউড়ের গড়

---

প্রাচীন সিলেট তিনভাগে বিভক্ত ছিল। গৌড়, লাউড় আর জয়ন্তিয়া। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও তার আশেপাশের এলাকা নিয়ে ছিল লাউড় রাজ্য। অতি প্রাচীনকালে কামরূপ রাজ্যের শাসক রাজা ভগদত্তের উপরাজধানী ছিল লাউড়ের গড়। মহাভারতের প্রথম অনুবাদকারী সঞ্জয় দত্তের বাড়ী ছিল এই এলাকায়। লাউড়ের পাহাড়ের নামানুসারে পৌরাণিক যুগের লাউড় রাজ্যের সাক্ষী এই লাউড়ের গড়। ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে যাদুকাটা নদীর পাশে এই লাউড়ের গড়। একদিকে পাহাড় আরেকদিকে বিস্তীর্ণ সমতল, সব মিলিয়ে অপূর্ব এক দৃশ্যপট যেন। 

লাউড়ের গড়ে রয়েছে শাহ আরেফিনের মোকাম। এখানে মেলা বসে, যার শুরু প্রায় ১০০বছর আগে। শাহ আরেফিনের আস্তানায় তাঁর স্মৃতিচিহ্ন এখনও রয়ে গেছে। অদূরেই হিন্দু সম্প্রদায়ের পণতীর্থ ধামে বারুণী স্নান ও মেলা একই সময়ে বসে যা দোল পূর্ণিমার ১৩দিন পরে। এই দুই মেলা উপলক্ষে সারাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় যাদুকাটার তীরে অবস্থিত লাউড়ের গড়। সীমান্তবর্তী হওয়ায় পার্শ্ববর্তী দেশ থেকেও পুণ্যার্থীরা আসেন।

যাদুকাটা নদী

---

এই নদীটি বাংলাদেশ ভারতের উত্তর পূর্ব সীমান্তের কোল ঘেষে বয়ে চলেছে। যাদুকাটার আদি নাম হচ্ছে রেণুকা। প্রচলিত আছে, কোন এক গাঁয়ের বধু শিশুপুত্রকে নিয়ে নদীর পাশে মাছ কাটছিলেন, অন্যমনস্ক হয়ে শিশুপুত্রকে কেটে ফেলেন অর্থাৎ তাঁর কোলের যাদুকে কেটে ফেলেন সেই থেকে এই নদীর নাম যাদুকাটা। নদীটি মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে বয়ে চলে লাউড়ের গড়ের বুক চিঁড়ে, এরপর প্রায় বিশ মাইল রক্তি নামে প্রবাহিত হয়ে সুরমার সাথে মিলিত হয়। যাদুকাটা নদীর পানি আশ্চর্য রকম ভাবে শীতল, প্রচণ্ড গরমেও এর পানিতে শরীর নিমেষে জুড়িয়ে যায়। এই নদীর একপাশে রয়েছে সুবিশাল বালুময় প্রান্তর। নদী থেকে শ্রমিকরা বালু ও পাথর আহরণ করে।

বারিক টিলা

---

স্থানীয়রা বলে বারিক্যার টিলা। এই টিলা অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাবেশ যেন। টিলার উপর থেকে মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড় দেখা যায়। টিলার উপর বেশ কিছু খাসিয়া পরিবার বাস করে। যাদুকাটা নদীর পাশেই এর অবস্থান। এই টিলায় মিষ্টি পানির ছড়া আছে।

নীলাদ্রি লেক

---

তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের টেকেরঘাট নামক স্থানে নীলাদ্রি লেকের অবস্থান। স্থানীয়রা যাকে বলে টেকেরঘাট পাথর কোয়ারি। মূলতঃ স্থানটি চুনাপাথরের পরিত্যক্ত খনির লাইম স্টোন লেক। ব্রিটিশ পিরিয়ডের স্থাপিত রেললাইন যা চুনাপাথর বহনে ব্যবহার হত, তার ধ্বংসাবশেষ এখনও রয়ে গেছে কালের সাক্ষী হয়ে। লেকের নীল পানি, ছোট বড় টিলা, পাহাড়, হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকা সবমিলিয়ে অপূর্ব এক প্রাকৃতিক ভূমি যেন ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর। নীলাদ্রি লেক এখন শহীদ সিরাজ লেক নামে অভিহিত।

শিমুল বাগান

---

সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুরের মানিগাঁও গ্রামে প্রায় ১০০বিঘারও বেশি জমির উপর চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন ২০০৩ সালে তিন হাজার শিমুল গাছ লাগিয়ে এই বাগানটি তৈরি করেছিলেন। যাদুকাটার পাশেই এই শিমুল বাগানের পাশেই মেঘালয়ের পাহাড়। শিমুল বাগানে রয়েছে লেবুর বাগান, ফাল্গুনের শুরুতে শিমুল বাগানে যেন আগুন লাগে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সৌন্দর্যপিপাসু, নান্দনিক চেয়ারম্যানের শিমুল বাগান এখন সারাদেশে সুপরিচিত, সারাদেশ থেকে সৌন্দর্যপিপাসুরা এসে ফাল্গুন মাসে এসে ভীড় জমান। 

টাংগুয়ার হাওর

---

প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। টাংগুয়ার হাওড়ের মোট আয়তন ৬৯১২ একর, যা বর্ষাকালে বেড়ে ২০,০০০একরে দাঁড়ায়। ১৪০ প্রজাতির মাছ, ২২প্রজাতির ব্যাঙ, এবং ১৫০ প্রজাতির বেশি সরীসৃপ রয়েছে এই হাওড়ে। শীতকালে প্রায় ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখী এখানে এসে ভীড় জমায়। টাঙ্গুয়ার হাওর মাছ-পাখী এবং উদ্ভিদের পরস্পর নির্ভরশীল এক অনন্য ইকোসিস্টেম। মাছের অভয়াশ্রম হিসাবে এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী। বর্ষাকালে এই হাওড় যেন অথই সমুদ্র, দূরের গ্রামগুলো ভাসমান দ্বীপের মত দেখা যায়। এখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। যার উপরে উঠে হাওড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। প্রচুর দর্শনার্থী তখন হাওড় দেখতে আসেন। অনেকে হাওড়ে জোছনা দেখতে রাত্রিযাপন করেন। বড় বড় নৌকায় সোলার প্যানেলের মাধ্যমে আধুনিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা আছে, আছে নৌকায় রান্নার সুবিধা।

উপসংহার:

---

 তাহিরপুর উপজেলাকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুললে সরকার প্রচুর রাজস্ব আদায় করতে পারবেন। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন আরও দ্রুতগতিতে শেষ করতে হবে। আধুনিক সুযোগসুবিধা সম্বিলত রিসোর্ট গড়ে তুললে ভবিষ্যতে আরও বেশি সংখ্যায় মানুষ তাহিরপুরে আসবেন। পর্যটনকে কেন্দ্র করে হয়ত বদলে যাবে এ উপজেলার সাধারণ মানুষের জীবনমান।

তথ্য সহায়তা: ইন্টারনেট, সুনামগঞ্জ ভ্রমণগাইড, উইকিপিডিয়া। 

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি