Loading..

খবর-দার

১৮ এপ্রিল, ২০২১ ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ

আমরা কি মুজিবনগরের শপথের মর্যাদা রক্ষা করছি?

আমরা কি মুজিবনগরের শপথের মর্যাদা রক্ষা করছি?

 
মুজিবনগর

গতকাল ১৭ এপ্রিল ছিল মুজিবনগর দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা থেকে ১২ কিলোমিটার পশ্চিমে ভারত সীমান্তলগ্ন বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। শপথ গ্রহণের পরপরই জায়গাটির নাম হয়ে যায় মুজিবনগর। পরবর্তীকালে আরও কিছু গ্রাম সংযুক্ত করে মুজিবনগর উপজেলা গঠন করা হয়। কাকতালীয় বিষয় হলো, এই মুজিবনগরের অনতিদূরেই পলাশীর আম্রকানন অবস্থিত। ১৭৫৭ সালে এই পলাশীর আম্রকাননেই ইংরেজদের কাছে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলা পরাধীন হয়ে যায়। ২১৪ বছর পর আবার সেই আম্রকাননের কাছে আরেকটি আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের সূর্যোদয় হয়।

আমরা সবাই জানি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা অপরিহার্য হলেও তা বাস্তবায়িত করার জন্য যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি কার্যকর সরকারের। সেই প্রয়োজন সামনে রেখে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত হয় একটি সরকার। সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু হিসাবে ধরা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ অর্থাৎ স্বাধীনতার ঘোষণার দিনটিকে। সেই সঙ্গে স্বাধীনতার সনদও তৈরি করা হয়। কিন্তু তা পাঠ করে শোনানো হয় ১৭ এপ্রিল, শপথের দিনে।

যে কোনো দেশের যে কোনো সরকার গঠনের পরই দায়বদ্ধতা সাপেক্ষে শপথের প্রয়োজন পড়ে। সে সময়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়েছিল ভারতে। কিন্তু সরকার মনেপ্রাণেই চাইল যেন শপথ অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশের স্বাধীন ভূখণ্ডে হয়। সে সময়ে পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে সারা দেশে অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। তাই নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়েছে। কারণ সে সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পরিকল্পনা প্রশস্ত করেছে। কেএম মহসিন ও মেজর রফিকুল ইসলামের বর্ণনামতে, ‘লে. জেনারেল এএকে নিয়াজি ১১ এপ্রিল পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। টিক্কা খানকে এ কমান্ডের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাকে গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নিয়াজি ইপিআরের স্থলে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস (ইপিসিএএফ) গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।’ এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাদের কর্মতৎপরতা কেবল সামরিক বাহিনীতেই সীমাবদ্ধ রাখল না; তারা এ দেশে তাদের সিভিল দোসরদেরও সক্রিয় করে তুলল। এর ভেতর দিয়েই তৈরি করা হয়েছিল রাজাকার, আল বদর, আল শামসের মতো কুখ্যাত বাহিনী। সুতরাং নিয়াজি তখন স্থানীয় ধর্মান্ধদেরও নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ফেলেন। এসব বিষয়কেও সরকারের বিবেচনায় রাখতে হয়েছে। শত বিবেচনার পর শেষতক বাংলাদেশের বৈদ্যনাথতলাকেই নির্বাচিত করা হয়, যা আজকের মুজিবনগর। খুব সংক্ষিপ্ত এই শপথ অনুষ্ঠানটি ১৭ এপ্রিল সকাল ১১:১০ মিনিটে শুরু হয়। অনুষ্ঠানে ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আওয়ামী লীগের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। ছোট আকারে গার্ড অব অনারও দেওয়া হয়। বাংলাদেশের দাপ্তরিক নামকরণ করা হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। ঘোষণাপত্র পাঠের পরপরই কয়েকজন তরুণের গলায় শোনানো হয়, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এটাই হয় আমাদের জাতীয় সংগীত। যেহেতু বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, তাই ঘোষণাপত্রের শেষের দিককার একটি ক্লজ অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদকে শপথবাক্য পাঠ করান উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সরকারের কার্যালয় নির্ধারিত হয় ভারতের কলকাতায়।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদে কেন আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করতে যাচ্ছি, তা পরিষ্কারভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা যুদ্ধে যেতে চাইনি, কোনো ধরনের রক্তপাত চাইনি। আমাদের যুদ্ধে নামতে বাধ্য করা হয়েছিল-এসব উল্লেখ করে ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্রুতি পালনের পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলাকালে একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন।’

কিন্তু কোন ক্ষমতাবলে উল্লিখিত ব্যক্তিরা সরকার গঠন করলেন? সেটাও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বচ্ছভাবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে যে রায় দিয়েছেন, সে মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং এতদ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি।’ সুতরাং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কার্যকারণ এবং কাদের দ্বারা তা পরিচালিত হবে, তা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে পরিষ্কার উল্লেখ ছিল। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে আমাদের সংবিধান প্রণয়নের আগ পর্যন্ত এটিই ছিল সংবিধান। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। সরকার গঠন করার এখতিয়ার কেবল সেই নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরই ছিল, যা তারা ১৭ এপ্রিল করেছেন।

সরকারের শপথের গুরুত্বকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কিন্তু ওই সরকারের মূল বা প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলার মানুষকে ‘বাংলাদেশ’ নামের একটি স্বাধীন ভূখণ্ড উপহার দেওয়া। মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্যের মধ্যে নীতি ও কৌশল নিয়ে হয়তো বা মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি থেকে তারা বিচ্যুত হননি। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত তারা একটি লাল-সবুজ পতাকা দিতে সমর্থ হয়েছেন। আমরা জানি, এর বিনিময়ে দিতে হয়েছে ৩০ লাখ প্রাণ আর ২ লাখ নারীর সম্ভ্রম।

যে কোনো দেশেই সরকার থাকে, তা সে যুদ্ধকালীন হোক কিংবা স্বাভাবিক সময়ে। স্বাধীন বাংলাদেশ পরিচালনার জন্য আমরা গত ৫০ বছরে এক ডজনেরও বেশি সরকার প্রত্যক্ষ করেছি। এর মধ্যে কোন সরকার কতটা গণতান্ত্রিক ছিল বা আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তো আছেই। কিন্তু সব সরকারের পরিচালনাকারী মন্ত্রিপরিষদ শপথবাক্য পাঠ করে থাকে। প্রথম সরকারের শপথে যেখানে স্বাধীনতার প্রশ্নটি ছিল, বর্তমান সময়ে তা সংগত কারণেই নেই। তবে এখনকার মন্ত্রিপরিষদের শপথবাক্যে শেষ কথাটি থাকে, ‘এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’ স্বাধীন বাংলাদেশে সব সরকার জনগণ দ্বারা নির্বাচিত ছিল না। সামরিক শাসনেও আমাদের অনেকটা সময় কাটাতে হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার হোক অথবা সামরিক সরকার, কোনো শাসকই শপথবাক্যের শেষাংশটির প্রতি সুবিচার করেননি। আইনের দৃষ্টিতে কিংবা অধিকারের দৃষ্টিতে সব মানুষের প্রতি সম-আচরণ করা হয়নি এবং হচ্ছে না। এই বৈষম্য রাজনীতির বেলায় যেমন সত্য, তেমনই অর্থনৈতিক অধিকারের বেলায়ও। কারও কারও পক্ষে এমন বক্তব্য মেনে নেওয়া কষ্টকর হলেও এটাই বাস্তব চিত্র।

আমরা বছর বছর মুজিবনগর দিবস পালন করি, কিন্তু সেই সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমলে নিতে চাই না। মুজিবনগর সরকার কারা গঠন করেছিলেন? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর হলো, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন তারা। পরের প্রশ্নটি হলো, কারা নির্বাচিত করেছিল? সাফ কথায় বলা যায়, বাংলার জনগণ। জনগণের সেই চাওয়ার মূল্য কিন্তু প্রথম সরকার দিতে পেরেছিল। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো সরকারই জনগণের দেওয়া রায়ের বিপরীতে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি কিংবা প্রত্যাশা পূরণের দিকে নজরই দেয়নি। কথা ছিল, দেশে কোন সরকার দায়িত্ব পালন করবে, তা জনগণই ভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করবেন। ৫০ বছর পরে এসে দেখা গেল ভোটের অধিকারটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। জাতীয় বলি আর স্থানীয়, সব স্তরের নির্বাচন থেকে জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জনগণের প্রতি প্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতার বোধও কমে গেছে বলে মনে হয়। তাই যে কোনো সমস্যা এখন আর সামাজিকভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। কারণ সমাজকে নানাভাবে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে। এর পরিণতি আমাদের ভোগ করতেই হবে। এ থেকে নিস্তার লাভ করতে হলে আমাদের শপথের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করতে হবে, যা আমাদের পূর্বসূরিরা করে গেছেন ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র দৈনিক যুগান্তর