Loading..

পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি/ইমেজ

১২ মে, ২০২১ ১১:২৩ অপরাহ্ণ

বাংলায় ব্রিটিশ শাসন (কলকাতা হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা)

কলকাতা হিন্দু কলেজ

১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি কলকাতায় স্থাপিত হয়। ভদ্র হিন্দু ঘরের সন্তানদেরকে ইংরেজি ও ভারতীয় ভাষাসমূহ ছাড়াও ইউরোপ ও এশিয়ার সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষাদান ছিল এই কলেজ স্থাপনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। বাংলার সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে কলেজটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভারতে ইংরেজ আগমনের পূর্বে বাংলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে বাংলা, সহজ পাটিগণিত ও সংস্কৃতের বাইরে উলে­খযোগ্য তেমন কিছু শিক্ষা দেওয়া হতো না। টোলসমূহে  উচ্চতর সংস্কৃত, ব্যাকরণ ও সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, ন্যায়শাস্ত্র ও দর্শনশাস্ত্র বিষয়ে পড়ানো হতো। এ শিক্ষা রাজা রামমোহন রায়ের মতো জ্ঞানালোকিত ভারতীয়দের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে নি। তাদের মতে, এ শিক্ষা ‘ব্যাকরণের সূক্ষ্মতা আর অধিবিদ্যার চুলচেরা বিশ্লেষণ দিয়ে তরুণদের মনকে অহেতুক ভারাক্রান্ত করবে’, কারণ বাস্তবে এ শিক্ষার কোন প্রতিফলন নেই। ব্রিটিশ বণিকদের সঙ্গে যাদের লেনদেন ছিল, তারা ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভব করেন। এই প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে কিছু বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।

ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠার ধারণাটি ততোদিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ সময়  ডেভিড হেয়ার-এর ভারতে ইংরেজি শিক্ষার পরিকল্পনা সবার সমর্থন লাভ করে। এতদুদ্দেশ্যে দীউয়ান বৈদ্যনাথ মুখার্জীকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট কমিটির চেয়ারম্যান এবং যোসেফ ব্যারেটো কোষাধ্যক্ষ হন। কমিটি ১,১৩,১৭৯ টাকা সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়। বর্ধমানের মহারাজা (তেজচাঁদ বাহাদুর) ও গোপীমোহন ঠাকুর উভয়েই কমিটিকে ১০,০০০ টাকা প্রদান করেন। আদিতে হিন্দু কলেজ দুটি শাখায় বিভক্ত ছিল। এর একটি পাঠশালা (স্কুল), অন্যটি মহাপাঠশালা (কলেজ)। স্কুলে ইংরেজি, বাংলা, ব্যাকরণ ও পাটিগণিত শিক্ষা দেওয়া হতো। অন্যদিকে কলেজে শেখানো হতো ভাষা, ইতিহাস, ভূগোল, ক্রনোলজি বা কালনিরূপণ বিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, অঙ্কশাস্ত্র, রসায়নবিদ্যা এবং বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়। উদ্বোধনী দিনে হিন্দু কলেজের ছাত্রসংখ্যা ছিল ২০। পরবর্তী তিন মাসে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৯ জনে।

হিন্দু কলেজের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা প্রবর্তনের সুদৃঢ় প্রয়াস। ভদ্র হিন্দু ঘরের সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হলেও কলেজের ভারতীয় ব্যবস্থাপকেরা হিন্দু ধর্মতত্ত্ব বা হিন্দু দর্শনশাস্ত্রের পরিবর্তে ইংরেজি সাহিত্য ও ইউরোপীয় বিজ্ঞান শিক্ষার ওপরই অধিক গুরুত্ব দিতেন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে হিন্দু কলেজ সমৃদ্ধি লাভ করে। কিন্তু এর সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে তহবিলের অভাব ছিল বড় বাঁধা। ডেভিড হেয়ারের পরামর্শে সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তার জন্য আবেদন করা হয়। ১৮২৪ সালে সুপারিশ করা হয় যে,  সংস্কৃত কলেজএর সেক্রেটারির পদ এবং জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন্স্ এর সেক্রেটারির পদ দুটি এক করা হোক। নতুন সংস্কৃত কলেজে হিন্দু কলেজকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সরকার দুটি স্বতন্ত্র ভবন নির্মাণ করতে সম্মত হয়। শুধু তাই নয়, হিন্দু কলেজে এক্স্পেরিমেন্টাল ফিলোসফি-র একটি পদ সৃষ্টিতেও সরকার সম্মত হয়। জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাক্শন্স এর সেক্রেটারি  হোরেস হ্যামেন উইলসন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এর কারণ, শিক্ষাদান পদ্ধতিতে কলেজ দুটি ভিন্নমত পোষণ করত। উপর্যুক্ত প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে হিন্দু কলেজের ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্র বিলীন হয়ে যেত এবং এটি শিক্ষার প্রাচ্যদেশীয় বিদ্যাপীঠের ইংরেজি শাখায় পরিণত হতো।

১৮২৪ সালে বেতন প্রথা পুনরায় চালু করা হয়। বিদ্যার্থীদের ধরে রাখার জন্য উইলসন বৃত্তি প্রদানের প্রস্তাব করেন। হরিনাথ রায় ও কালিশঙ্কর ঘোষালের আর্থিক সহায়তার কল্যাণে এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়। সিনিয়র ও জুনিয়র এই দুটি বিভাগ নিয়ে হিন্দু কলেজ তার কার্যক্রম শুরু করে। প্রত্যেক বিভাগে ছিল চারটি করে ক্লাস। এই প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি, বাংলা অথবা সংস্কৃত এবং ফারসি ভাষা শেখানো হতো। ফারসি শেষাবধি সংস্কৃত ভাষার জায়গা দখল করে। ১৮২৪ সালে ডি রস বিজ্ঞান-ক্লাসসমূহ শুরু করেন। ১৮২৮ সাল নাগাদ এই ক্লাসগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রবার্ট টাইটলার-এর নিয়োগ বিজ্ঞানবিভাগের সৌন্দর্য্য ও আকর্ষণ আরও বৃদ্ধি করে। এভাবে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে কলেজ। ১৮৩১ সালে জেনারেল কমিটি এই বলে সন্তোষ প্রকাশ করে যে, ছাত্ররা ইংরেজি ভাষায় প্রশংসনীয় দক্ষতা অর্জন করেছে, এমনকি বিজ্ঞানের সঙ্গে তাদের পরিচয় কখনও কখনও ইউরোপীয় ছাত্রদের প্রায় সমতুল্য।

১৮২৮ সালে  অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান হেনরী লুই ভিভিয়ান  ডিরোজিও ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের শিক্ষক নিযুক্ত হন। ছাত্রদের ওপর তাঁর বিস্ময়কর প্রভাব ছিল। তাঁর ছাত্রদের অনেকেই নিজেদেরকে  ইয়ং বেঙ্গল গ্রুপের সদস্য বলে অভিহিত করত।

হিন্দু কলেজের ছাত্রসংখ্যা শুধু বৃদ্ধিই পাচ্ছিল না, বরং সম্প্রসারিত হচ্ছিল এর পাঠ্যক্রমও। আইন ও ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বিষয়ে অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করায় কলেজের কর্মপরিধিতে একটি নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। ১৮৩৫ সালে লর্ড  মেকলেএর বিখ্যাত ‘মিনিটস’ প্রকাশিত হলে ইংরেজি শিক্ষা নতুন প্রেরণা লাভ করে। একই বছর হিন্দু কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে ক্যাপ্টেন ডেভিড লেসটার রিচার্ডসন-এর নিযুক্তি প্রমাণ করে যে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটছে। ১৮৩৯ সাল নাগাদ অতিরিক্ত কিছু নিয়োগের মাধ্যমে সরকার হিন্দু কলেজকে আরও সাহায্য প্রদান করেছিল। ১৮৪৭ সালে একটি উলে­খযোগ্য প্রশাসনিক পরিবর্তন ঘটে। কলেজের শীর্ষপদ হিসেবে প্রিন্সিপ্যাল-এর একটি স্বতন্ত্র পদ সৃষ্টি করা হয়। ধীরে ধীরে হেড মাস্টার-এর পদটি বিলোপ করা হয় এবং দুটি শাখাকে একটি একক ব্যবস্থাপনার অধীনে আনা হয়। ১৮৪৭ সালেই ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’ এবং ‘একস্পেরিমেন্টাল’ ও ‘ন্যাচারাল ফিলোসফি’ বিষয়ে অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করা হয়। শর্ত থাকে যে, উপর্যুক্ত বিষয়ে প্রদত্ত লেকচারাদি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত হবে। এর ফলে হিন্দু কলেজ তার সাম্প্রদায়িক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে যেতে সমর্থ হয়।

ইংরেজি শিক্ষার চাহিদা এ সময় দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় সরকার আরও কলেজ স্থাপনের প্রয়োজন উপলব্ধি করে, বিশেষত যে সমস্ত কলেজে ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান সকলেই পাঠগ্রহণ করতে পারবে। যেহেতু হিন্দু কলেজ কেবল হিন্দুদের জন্যই উন্মুক্ত ছিল সেহেতু সরকার এটিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (যদিও অনুদানপ্রাপ্ত) হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন করে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সব সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত এবং সরকার দ্বারা পরিচালিত একটি নতুন কলেজ স্থাপনের প্রশ্নটিও বিবেচনা করা হয়। অধিকতর অর্থ ব্যয়ে একটি নতুন কলেজ স্থাপনের চাইতে হিন্দু কলেজকে সরকারি ব্যবস্থাধীন একটি ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার প্রস্তাব সরকারের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। রসময় দত্ত ব্যতীত কলেজের অন্যান্য ভারতীয় ব্যবস্থাপক এ-প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। অবশ্য সরকার তাদের বিরোধিতা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। ১৮৫৪ সালের ১১ জানুয়ারি হিন্দু কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটি শেষবারের মতো মিলিত হয়। এই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর  কোর্ট অব ডাইরেক্টর্সএর অনুমোদন সংবলিত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অবশেষে ১৮৫৫ সালের ১৫ এপ্রিল হিন্দু কলেজের পরিসমাপ্তি ঘটে। তার স্থলে আবির্ভূত হয়  প্রেসিডেন্সি কলেজ, ১৮৫৫ সালের ১৫ জুন যার যাত্রা শুরু।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি