Loading..

পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি/ইমেজ

২৬ মে, ২০২১ ০৮:১৫ পূর্বাহ্ণ

&& বিদ্রোহী কবি, নজরুল এর জীবনী &&
কাজী নজরুল ইসলাম এক বাঁধভাঙা প্রতিভা। লেখালেখিতে যেমন ছিলেন বিদ্রোহী, তেমনি তাঁর জীবনও হাঁটেনি চেনা পথে। লেখালেখি ও জীবনযাপন মিলিয়ে ছিলেন ব্যতিক্রমী। নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজন
কাজী নজরুল ইসলাম (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬—১২ ভাদ্র ১৩৮৩), প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
কাজী নজরুল ইসলাম (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬—১২ ভাদ্র ১৩৮৩), প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

নজরুল ইসলামকে নিয়ে কতগুলো জীবনী লেখা হয়েছে, তার সংখ্যা আমার জানা নেই। তবে আমার বিশ্বাস, অত জীবনী অন্য কোনো বাঙালিকে নিয়ে লেখা হয়নি, এমনকি রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও নয়। এর একটা কারণ নজরুল সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাব। বিশেষ করে সৈন্যবাহিনী থেকে তিনি কলকাতায় ফিরে আসার আগের সময়টা আমাদের কাছে একান্ত অস্পষ্ট। শোনা কথা, যে যা কল্পনা করতে পেরেছেন, তিনি তাই লিখেছেন।
তাঁর সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারতেন, এমন কোনো যোগ্য আত্মীয় তাঁর ছিল না। তাঁর দুই ভাই ছিলেন, লেখাপড়া সামান্যই জানতেন। তাঁরা তাঁর জীবন সম্পর্কে নতুন কোনো আলোকপাত করতে পারেননি। তাঁরা দেখেছিলেন বালক এবং কিশোর নজরুলকে, যাঁর বালকসুলভ কাজকর্ম তাঁদের মনে থাকার কথা নয়। সুতরাং তাঁদের কাছ থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি। তাঁর পুত্ররা—সব্যসাচী আর অনিরুদ্ধ—কলকাতা-পূর্ব অধ্যায় সম্পর্কে না হলেও, কলকাতা অধ্যায় সম্পর্কে হয়তো তথ্য দিতে পারতেন। কিন্তু নজরুল যখন মানসিক রোগে আক্রান্ত হলেন, তখন তাঁরা বালক মাত্র। তাই তাঁরা কেউ তাঁদের পিতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু লিখেছেন বলে জানি না। আর লিখে থাকলেও, সেও শোনা কথা। নজরুল সুস্থ থাকা অবস্থায় তাঁর কোনো জীবনী প্রকাশিত হলেও তা নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হতো। সুতরাং যেসব নজরুল-জীবনী লেখা হয়েছে, সেগুলো অংশত কিংবদন্তিমূলক। এবং বীরপূজা বিশেষ।
তিনি যে পরিবারে জন্মেছিলেন, সে পরিবারের বিদ্যা অথবা বিত্ত—কোনোটাই ছিল না। এখন যে সে পরিবারের ওপর গৌরব আরোপ করে তাঁর পূর্বপুরুষদের আয়মাদার এবং কাজী ইত্যাদি বিশেষণে বিভূষিত করা হয়, তার কারণ পরবর্তীকালে তাঁর অসামান্য কীর্তি এবং গৌরব। আমরা ধরেই নিই যে, তিনি যখন অমন বড় হয়েছিলেন, তখন তাঁর পূর্বপুরুষেরাও নিশ্চয়ই অভিজাত ছিলেন। এই সিদ্ধান্ত মাথায় নিয়েই আজহারউদ্দীন থেকে শুরু করে নবীনতম নজরুল-জীবনীকার পর্যন্ত লেখকেরা তাঁদের যাত্রা আরম্ভ করেন। কিন্তু নজরুল যা হয়েছিলেন, তা নিজের প্রতিভা দিয়েই হয়েছিলেন, পরিবারের কারণে নয়। তিনি যে পরিবারে জন্মেছিলেন, সে পরিবারে সন্তানদের জন্মতারিখ পর্যন্ত লিখে রাখার ঐতিহ্য ছিল না। কেউ কি জানে তাঁর বড় ভাই সাহেবজান তাঁর থেকে ক বছরের বড় ছিলেন। অথবা ছোট ভাই আলী হোসেন ক বছরের ছোট ছিলেন? অথবা তাঁর মা কে ছিলেন? পিতা দরিদ্র ছিলেন, কিন্তু কী করে জীবিকা উপার্জন করতেন? এসব তথ্য খোঁজা বাহুল্য।

গুরুত্বপূর্ণ যা, তা হলো: তিনি কী করে হঠাৎ একদিন উল্কার মতো বাংলা সাহিত্য এবং সংগীতজগতের মধ্যগগনে আবির্ভূত হয়ে সমস্ত আকাশকে উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন। কী করে তিনি দুখু মিয়া থেকে নজর আলি, নজর আলি থেকে নজরুল এসলাম, নজরুল এসলাম থেকে নজরুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম, এবং শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম হয়ে উঠলেন, সেই বিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ এবং আগ্রহব্যঞ্জক।
আসলে তিনি ছিলেন এক অসাধারণ প্রতিভা। তাঁকে সাধারণ মানুষের মাপে বিচার করতে গেলে ভুল হওয়ারই কথা। কিন্তু আর পাঁচজন মানুষের মতো তাঁকে চিরাচরিত ছকে গড়ে তুলেছেন জীবনীকারেরা। তিনি যে ব্যতিক্রম, সেটা অনেকেই মাথায় রাখেননি। তাঁর বেলাতে প্রতিষ্ঠিত রীতি যে অচল হতে পারে, তাঁরা সেটাও মনে করেননি।
সঠিক তথ্যের অপ্রতুলতা ছাড়াও নজরুল ইসলামের একটি আদর্শ জীবনী লেখার দ্বিতীয় সমস্যা হলো, একেবারে গোড়ার সমস্যা। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের কয়েকটি জীবনী রচিত হলেও, অথবা মুকুন্দরাম ও ভারতচন্দ্র তাঁদের জীবনের কয়েকটি তথ্য রেখে গেলেও, বাংলা ভাষায় জীবনী লেখার কোনো ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। ইরেজি জীবনী-সাহিত্যের আদলে বাংলা ভাষায় জীবনী রচনা আরম্ভ হয় উনিশ শতকে। এবং এর তিনটি মডেল তৈরি হয়। প্রথমত, জন্ম, পরিবার, শিক্ষা, বিবাহ, কর্মজীবন এবং মৃত্যুর মতো একেবারে মৌলিক তথ্যের সংগ্রহ। ঈশ্বর গুপ্ত এ ধরনের জীবনীর সূচনা করেন। নগেন্দ্রনাথ সোম ও যোগীন্দ্রনাথ বসু তাকে উন্নত করেন এবং এর চূড়ান্ত রূপ দেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্য-সাধক চরিতমালায়। কিন্তু জীবনী মানে তথ্যের তালিকা নয়। এমনকি সন-তারিখের তালিকাও নয়।
জীবনী লেখার দ্বিতীয় মডেল প্রবর্তন করেন শিবনাথ শাস্ত্রী—তাঁর রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ গ্রন্থে। সমাজের সমান্তরালভাবে কোনো ব্যক্তির জীবনকে বিচার-বিশ্লেষণ করা নিঃসন্দেহে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ। সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে যাঁর জীবনী লেখা হচ্ছে, তাঁকে দেখার দৃষ্টিকোণ। সমাজের সঙ্গে তুলনা করে তাঁর জীবনের মূল্যায়ন করা। এর ফলে যাঁকে নিয়ে লেখা হচ্ছে, তাঁর জীবন ও প্রবণতা বোঝার বিষয়ে একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। এই মডেলটি পরে অনেকেই গ্রহণ করেন; তবে আজও এই মডেলের সবচেয়ে নামকরা গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয় রামতনু লাহিড়ী। কিন্তু এই জীবনীতে উনিশ শতকের সামাজিক ইতিহাস যতটা চোখে পড়ে, রামতনু লাহিড়ীকে ততটা দেখা যায় না। সেদিক দিয়ে বিচার করলে জীবনী হিসেবে এ বই অসম্পূর্ণ, এমনকি ব্যর্থ। কিন্তু এ গ্রন্থ জনপ্রিয় হওয়ার পর এর অনুকরণে অনেকেই সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে জীবনী রচনা করতে আরম্ভ করেন। এর মধ্যে রামমোহন ও তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্য (১৯৭১) গ্রন্থে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় আরও একটা মাত্রা যুক্ত করেন সাহিত্যকে নিয়ে এসে।

বিদ্রোহের বহুমাত্রা

এরপরে আসে বাংলা-পড়ুয়াদের পিএইচডি করার যুগ। সেই সূত্রে অনেকেই জীবনীর কিছু তথ্য এবং সাহিত্যের কিছু আলোচনা দিয়ে ‘অমুকের জীবন ও সাহিত্য’ নামে অসংখ্য কাজ করেন। এর মধ্যে অনেকগুলো কাজ মুদ্রিত হয়ে বই আকারে প্রকাশিতও হয়। মুশকিল হলো, এসব কাজ না সত্যিকার জীবনী, না সত্যিকার সাহিত্য-বিচার। এগুলোকে বলা যায়, জীবনের তথ্য ও সন-তারিখের ফর্দ এবং বিবরণ। সেই সঙ্গে সাহিত্যের খবর। কোন বই কবে প্রকাশিত হয়েছিল, বিষয়বস্তু কী, এবং এখান সেখান থেকে কিছু উদ্ধৃতি। সাহিত্য-আলোচনা একে ঠিক বলা যায় না। কারণ, এতে সাহিত্যের বিশ্লেষণ, রসাস্বাদন অথবা মূল্যায়ন তেমন থাকে না। সবচেয়ে কম মেধা নিয়ে এই ধরনের জীবন ও সাহিত্য মার্কা-মারা গ্রন্থ রচনা করা যায়। বলা যায় যে, এগুলো জীবনী নয়, এগুলো হলো ব্যক্তি বিশেষের পরিচিতিমূলক গ্রন্থ।
তৃতীয় শ্রেণির গ্রন্থগুলো সরাসরি জীবন নিয়ে আলোচনা। যেমন, মুজফ্ফর আহমদের কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা (১৯৬৫) অথবা প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের নজরুল ইসলাম (১৯৫৫, ১৯৮৩)। এ–জাতীয় বইকে ঠিক জীবনীগ্রন্থ বলা যায় না। এগুলো জীবনীমূলক রচনা, জীবনী রচনার সহায়ক গ্রন্থ। এ ধরনের বইয়ে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা থাকে না অথবা সামান্যই আছে। কিন্তু নজরুল জীবনী রচনায় এই দুই বই-ই মূল্যবান অবদান রেখেছে। বিশেষ করে মুজফ্ফর আহমদ অসীম নিষ্ঠা নিয়ে তাঁর স্মৃতিকথা রচনা করেছেন। নজরুল-জীবনীগুলোতে যা বিরল জিনিস—মুজফ্ফর আহমদ বহু জনপ্রিয় কিংবদন্তি ভেঙে দিয়েছেন। প্রয়োজনবোধে নজরুলের কড়া সমালোচনা করতেও পিছপা হননি। আরও বিরল: মুজফ্ফর আহমদ ঘটনাবলির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন।
নাম থেকেই বোঝা যায়, আজহারউদ্দীন খানের বাংলা সাহিত্যে নজরুল (১৯৫৪) জীবনীগ্রন্থ নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এ বইয়ের প্রথম অংশে আছে নজরুলের বংশ পরিচয় থেকে আরম্ভ করে, জীবনসায়াহ্ন পর্যন্ত নানা ঘটনার বিবরণ—একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী। তাঁর এই জীবনী শোনা-কথা-নির্ভর এবং অনেক জায়গায় ভ্রান্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত। তা সত্ত্বেও নজরুলের জীবনী সম্পর্কে একেবারে গোড়ার দিকে যাঁরা কাজ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনি প্রধান। আবদুল কাদিরের নজরুল-প্রতিভার স্বরূপ (১৯৮৯) গ্রন্থটিও আজহারউদ্দীন খানের বইয়ের মতো। এতেও প্রথমাংশে আছে জীবনী। তারপরে আছে নজরুল সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা। শুধু জীবনী নিয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা অরুণকুমার বসুর নজরুল-জীবনী। এতেও সাহিত্যের আলোচনা আছে, কিন্তু লেখকের মূল লক্ষ্য নজরুলের জীবনী। ৪৫টি অধ্যায়ে বিভক্ত করে লেখক বিদ্রোহী কবির জীবনের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেছেন। অন্য যেসব জীবনী লেখা হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় এ বইয়ে বেশি তথ্য আছে। কিন্তু জীবনের ঘটনাবলির মধ্যে যে ঐক্যসূত্র আছে, তা লেখক ধরতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তথ্যগুলোকে লেখক কোনো ধারণাগত কাঠামোর মধ্যে ফেলে বিচার করতে চাননি। ধারণাগত কাঠামোর কথা তিনি মনে রেখেছিলেন কি না, সে সম্পর্কেও পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে।
বাংলা জীবনী সাহিত্যের আরেকটি সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতা হলো: যাঁর জীবনী রচনা করা হচ্ছে, তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত করার প্রয়াস। কিন্তু মানুষ যে কেবল মহৎ হতে পারে না, মানুষ যে দোষে-গুণে মানুষ—জীবনী লেখকেরা সেটা ভুলে যান। মনে আছে, আমার মাইকেল-জীবনী আশার ছলনে ভুলি প্রকাশিত হওয়ার পর এক পার্টিতে আমাকে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আমি যে এই জীবনী লিখেছি, সে কি মাইকেলকে বড় করার জন্য, নাকি তাঁকে ছোট করার জন্য। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম: মাইকেলকে আমি বড় করিনি, ছোটও করিনি, তিনি যেমন ছিলেন বলে আমার মনে হয়েছে, তাঁকে তেমন করে দেখাতে চেষ্টা করেছি। জীবনীকার চাটুকার নন। নিন্দুকও নন।
জীবনীকারের কাজ যাঁর জীবনী লিখছেন, তাঁর জীবনের ঘটনাবলির মধ্যে কোনো প্যাটার্ন আছে কি না, তা দেখানো। যেমন মাইকেল বারবার অপরিচিত জায়গায় গিয়ে ভাগ্যান্বেষণ করেছেন—এটা তাঁর চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য। হাতে টাকা এলে তিনি ভালো বাড়িতে বাস করতেন, আবার দারিদ্র্যে আক্রান্ত হলে গরিব পাড়ার কম ভাড়ার বাড়িতে বাস করতেন। তিনি মহাকাব্য রচনা করলেও কল্পনাবিলাসী ছিলেন। তিনি নিজেকে জাহির করতে ভালোবাসতেন। তিনি বন্ধুত্বপূর্ণ হলেও ঘরের খবর কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতেন না। এগুলো তাঁর জীবনের প্যাটার্ন।
নজরুল পান খেতেন বারবার; চা-ও খেতেন বারবার। কোনো কোনো লেখক এ কথা মনে রেখে কল্পনায় ভেসে গিয়ে কিছু বিচার-বিশ্লেষণ না করেই বলেছেন যে, নজরুল করাচি থেকে ফেরার পর কলেজ স্ট্রিটের বাড়িতে থাকতেন, তখন সেখানে গিয়ে দেখলেন, তিনি একের পর এক পান খাচ্ছেন, আর কাপের পর কাপ চা খাচ্ছেন। সৈন্যবাহিনী থেকে সদ্য ফিরে-আসা একজন মানুষের পক্ষে ক্ষণে ক্ষণে পান খাওয়া যে অস্বাভাবিক, পান খাওয়ার অভ্যেস তৈরি হতে যে বেশ কিছুদিন সময় লাগে, সেটা তাঁরা বিবেচনা করেননি। তা ছাড়া, বারবার পান খেতেন, এটা কবির একটা (বদ্)অভ্যেস, তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নয়। বরং গোলাম মোস্তফা যখন তাঁকে দেখে লেখেন—
ভায়া লাফ দেয় তিন হাত,/ হেসে গান গায় দিন রাত,
প্রাণে ফুর্তির ঢেউ বয়,/ ধরার পর তার কেউ নয়।
তখন তাঁর মধ্যে আক্ষরিকভাবে অতিরঞ্জন যতই থাক, খাঁটি নজরুলকে দেখতে পাই। ঘটনার উল্লেখ না থাকলেও দেখতে পাই। এটা একজন কবির দৃষ্টিতে এক কবিকে দেখা। আর জীবনীকারের কাজ হলো: ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে জীবনের প্যাটার্ন, চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা, একজন রক্তমাংসের মানুষের চিত্র অঙ্কন করা। ঘটনার ফিরিস্তি দেওয়া নয়। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি কাফের ছিলেন, সেটা প্রমাণ করা জীবনীকারের কাজ নয়। তেমনি তিনি ধার্মিক ছিলেন, অথবা আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে তিনি খাঁটি মুসলমান ছিলেন, এটা দেখানোও জীবনীকারের কাজ নয়।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, মুসলমান-প্রধান বাংলাদেশে নিরাসক্ত নজরুল-জীবনী রচনা করার একটা মস্ত বাধা হলো, তাঁর সত্যিকার ধর্মীয় পরিচয়। তিনি মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলেন, জীবনের একটা পর্যায় পর্যন্ত তিনি ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে নিজেকে শনাক্ত করতেন। তারপর তিনি যে আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে কেবল মানুষ হিসেবে দেখেছিলেন, এ কথা বললে রক্ষণশীলদের অনেকেই তেড়ে আসবেন। জীবনের একটা পর্যায়ে তিনি যে কালীর সাধনা করতেন, সে কথা শুনলে এই রক্ষণশীলেরা লাঠি মারবেন কি না, জানা নেই।
আসলে বাংলাদেশে নজরুল ইসলাম সম্পর্কে নির্মোহ বিচার করা শক্ত। একদল লোক আছেন, যাঁরা তাঁর সম্পর্কে সত্য কথা শুনতে চান না। কিন্তু একজন বড় কবির সবকিছুই বড় মাপের হবে, সর্বাঙ্গীণ সুন্দর এবং সুগোল হবে—এমন কি কোনো কথা আছে? মাইকেল মদ্যপ ছিলেন, তাই বলে কি মহাকবি হিসেবে তাঁর মূল্য কিছু কমে গেছে? বোদলেয়ারের মৃত্যু হয়েছিল সিফিলিসে ভুগে, তাঁর জন্য কি কবিতা মূল্য হারিয়েছে? হারায়নি। বরং দেড় শ বছর পরেও রোমান্টিক কবি হিসেবে তিনি ভাস্বর। তেমনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর রাফায়েল মারা গিয়েছিলেন সিফিলেসে ভুগে, তার জন্য তাঁর চিত্রের মূল্য কি কিছুমাত্র হ্রাস পেয়েছে? নজরুল-জীবনেও অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল, অন্ধকার দিক ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্য এবং সংগীত-আকাশের চোখধাঁধানো জ্যোতিষ্ক। তাঁর জীবনের একসময়ে তিনি ‘খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’ বিস্ময়ের মতো আবির্ভাবের ঘোষণা দিয়েছিলেন; ভগবান-বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতে চেয়েছিলেন—সমকালীয় রক্ষণশীল লোকেরা অনেকে এ কথাগুলোকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে তাঁকে নমরুদ, ফেরাউন ও কাফের আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন কি তাঁর মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁকে ছোট করা হবে? নজরুলের কপাল ভালো, তা করা হয় না। বরং তাঁকে কেউ কেউ পাক্কা মুসলমান বলে দাবি করেন। এটাও মিথ্যা প্রচার, ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত। তিনি মানুষ, তিনি মানুষ, তারপরেও তিনি মানুষ। একজন মহান মানুষের মতোই তাঁকে দেখতে হবে। মানুষকে অবহেলা করে যারা ভজনালয়ে গিয়ে উপাসনা করে, তিনি সেসব ভজনালয় ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেটাকে সঠিক প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে। আক্ষরিক অর্থে নয়। আসলে এ আহ্বানের অর্থ শিঙ্গার মহা হুংকার দিয়ে মানুষের জয়গান ঘোষণা।
মনে আছে, দু-তিন বছর আগে নজরুলের জন্মদিন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত এক সভায় আমি কবির বিয়ের তারিখ (২৫ এপ্রিল ১৯২৪) আর তাঁর প্রথম পুত্রের জন্মতারিখ (১৮ আগস্ট ১৯২৪) উল্লেখ করে বলেছিলাম যে, নজরুল যখন বিয়ে করেন, তখন প্রমীলা কয়েক মাসের গর্ভবতী ছিলেন (কারণ, মাত্র তিন মাস তেইশ দিনে সন্তান হয় না, হতে পারে না।—তাই নিয়ে একটা হইচই হয়েছিল। মন্ত্রী-সচিব প্রমুখের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার দরখাস্ত গিয়েছিল। পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছিল, বিবৃতি ছাপা হয়েছিল। নজরুল যে জাতীয় কবি, তারও দোহাই দেওয়া হয়েছিল। এই মনোভাব নিয়ে নিরাসক্ত জীবনী লেখা যায় না, জীবন ও চরিত্রকে বোঝার মতো সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। যথার্থ মূল্যায়নও করা যায় না। নজরুলের আদর্শ জীবনী তাই এখনো লেখা হয়নি

&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&&

মো: নাজমুল হক শামীম

সহকারি শিক্ষক

থুপসারা সেলিমীয়া দাখিল মাদরাসা

কালাই, জয়পুরহাট।

জেলা অ্যাম্বেসেডর, জয়পুরহাট।

মোবাইল : ০১৭২১৭০৭৪৫৫

ই-মেইল : [email protected] 


 শিক্ষক বাতায়ন লিংক :

https://www.teachers.gov.bd/profile/atnazmul81


ফেসবুক লিংক ;

https://www.facebook.com/nazmulhaqueshamim.shamim

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি