Loading..

পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি/ইমেজ

১৩ জুন, ২০২১ ০৯:৩৩ পূর্বাহ্ণ

ইন্টারনেট এর ব্যবহার

ইন্টারনেটের এ যুগে শিশুরা থাকুক সুরক্ষিত

ইন্টারনেট মানুষের জীবনকে গতিময় ও সহজ করে দিয়েছে। এর উৎকর্ষতা আমাদের জীবনযাপন প্রণালির সার্বিক খোলনলচেই পালটে দিয়েছে। অফিসের কাজকর্ম, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া, জ্ঞানচর্চা, দৈনন্দিন কার্য সম্পাদনসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান ও গ্রহণে ইন্টারনেটের ওপর মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে।

বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে বসবাসকারী প্রিয়জন, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে অল্প খরচে চ্যাটিং, ভিডিও চ্যাটিংসহ প্রয়োজনীয় তথ্য আদান-প্রদান করা যাচ্ছে। জীবনযাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন ইন্টারনেটের গুরুত্ব বাড়ছে। সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় করোনাকালে ইন্টারনেটের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আরও নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করা যাচ্ছে।

এ যুগে যার হাতে স্মার্ট ডিভাইস আছে, সাধারণত সে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছে। সেটি হতে পারে মোবাইল ডেটা বা ওয়াই-ফাই। আর মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধাই তো এ ফোনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

প্রতিদিন ইন্টারনেটের গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। মানুষের সার্বিক চিন্তা-চেতনা ও কার্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তনকারী এ ইন্টারনেট আসলে কী? ওয়েবসার্চ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটস্অ্যাপ, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও বিশ্বের বিশাল তথ্যভাণ্ডারে প্রবেশাধিকার ইন্টারনেট প্রদান করে থাকে। বিবিসির তথ্যমতে, ইন্টারনেটের সূচনা হয়েছিল মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের একটি গবেষণা প্রকল্প থেকে।

১৯৮৮ সালে প্রথম দিকে এ ধরনের নেটওয়ার্কের সঙ্গে কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে এবং সুইডেন যুক্ত হওয়ায় এটি একটি আন্তর্জাতিক অবয়ব লাভ করে। পরে ১৯৯৫-২০০৫ সালের মধ্যে পরিপূর্ণ ইন্টারনেট সেবা কার্যক্রম চালু হয়।

এখন আমরা শিশু সন্তানের হাতে দামি মোবাইল সেট, ট্যাব, ল্যাপটপ তুলে দিচ্ছি। কিন্তু অ্যাপেলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস্ ২০১০ সালে বাজারে আইপ্যাড আনার পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, তার সন্তানরা এটি ব্যবহার করে না।

তাদের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। শুধু স্টিভ জবস্ নন, অন্যান্য প্রযুক্তির পুরোধারাও সন্তানদের প্রযুক্তি পণ্য থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখছেন। ৩ডি রোবটিকস-এর প্রধান নির্বাহী পরিচালক ক্রিস অ্যান্ডারসন বলেন-‘আমি এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমি চাই না, আমার সন্তানদের বেলায় এমনটি হোক’।

যেহেতু সন্তানরা মাকেই বেশি অনুকরণ করেন তাই তিনি তার স্ত্রীকেও প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার করতে দেন না। প্রযুক্তি পণ্য থেকে সব শিশু-কিশোরকে যদি বিরত রাখা না-ই যায়, তবে কম অপশনসম্পন্ন স্বল্পমূল্যের মোবাইল সেটের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো শিক্ষার্থী সে যে পর্যায়েরই হোক না কেন, তার হাতে দামি সেট থাকা উচিত নয়।

দামি সেট অন্যদের দেখানোর জন্য হাতে রাখার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রয়োজনহীন বিচরণ বাড়তে বাড়তে তা নেশায় পরিণত হচ্ছে। স্বল্পমূল্যের সেট সন্তানের মোবাইল আসক্তি কমাতে সাহায্য করতে পারে। বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি কি শিক্ষার্থীবান্ধব মোবাইল সেট তৈরি করতে পারে না? অবশ্যই পারে।

তার আগে ছোটদের জন্য এ ধরনের মোবাইল ব্যবহারের বিষয়ে মাইন্ডসেট ঠিক করতে হবে। গণমাধ্যম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

শিক্ষার্থী ও উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা এখন লেখাপড়া অপেক্ষা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যস্ত থাকতে বেশি পছন্দ করে। এ ব্যাপারে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুল চলাকালেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী।

বহু শিক্ষার্থী আবার ক্লাসের পাঠদান চলাকালেই এর মধ্যে ডুবে থাকছে। এতে তাদের লেখাপড়ায় আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলছেন, এ আসক্তি মাদকের চেয়েও ভয়াবহ।

তিনি আরও বলছেন, অনেকেই পাঁচ মিনিট পরপর ফেসবুকে ঢুকছেন, নোটিফিকেশন চেক করছেন, এটা করতে না পারলে অস্থির হয়ে পড়ছেন। বিষয়টি এমন যেন ফেসবুক বা টুইটার জীবনের সব।

বিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলছে এর ব্যবহারকারীদের ২৯.৭ শতাংশের বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছর। এছাড়া ব্যবহারকারীরা গড়ে প্রতিদিন ২০ মিনিট সময় কাটান ফেসবুকে। ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে এবং সাইবার ক্রাইমের মাত্রা বেড়ে গেছে। কেউ কেউ বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে, যা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সচ্ছল ঘরের শিশুরা সাধারণত খাওয়া-দাওয়া করতে চায় না। আর এ নিয়ে বাবা-মার উদ্বেগের শেষ নেই। তাই ইন্টারনেটযুক্ত স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে ইউটিউবের রকমারি আয়োজন, কার্টুন ও ভিডিও গেম দেখিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে। মায়েদের চাকরিসহ বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত হওয়ার মাত্রা বাড়ছে।

ফলে মা-বাবার অনুপস্থিতিতে সন্তানকে শান্ত রাখার জন্য তার হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে ল্যাপটপ, ট্যাব ও স্মার্ট ফোন। এতে ছোটবেলা থেকে এসব ডিভাইসের প্রতি শিশুর আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ওয়েবসাইটে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা ও আসক্তি দুটোই বেড়ে যাচ্ছে।

তাই ইন্টারনেট যুক্ত স্মার্ট ডিভাইস কোনো শিশুর হাতে তুলে দেওয়ার আগে অবশ্যই একটু ভাবতে হবে। শিশু সন্তানদের এসব থেকে দূরে রাখতে হবে। সে অনলাইনে কী করছে, কী কাজে সময় ব্যয় করছে তা বোঝার জন্য অভিভাবক, বিশেষত মায়েদের অনলাইন সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকতে হবে। অবাধ ইন্টারনেটের এ যুগে শিশুদের বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এসব বিষয়ে অভিভাবকদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।

স্মার্ট ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় এছাড়া চিন্তাশক্তি ও শারীরিক সামর্থ্য কমে যেতে পারে। তাই বাসার ওয়াই-ফাই দিনের নির্দিষ্ট কিছুটা সময় বন্ধ রাখতে পারলে মোবাইলের ব্যবহার এমনিতেই কম হবে।

এতে সবাই ইন্টারনেটের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কিছুটা সময়ের জন্য রেহাই পাবে, একই সঙ্গে রাউটার ও অন্যান্য নেটওয়ার্ক সামগ্রীর স্থায়িত্বও একটু বাড়বে।

প্রতিনিয়ত শিশু-কিশোররা কেন ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে? আগে মহল্লা/এলাকার সবাই সবাইকে চিনত, যাওয়া-আসা ছিল, এখন নেক্সট ডোর নেইবারের সঙ্গেই কোনো পরিচয় ও যাওয়া-আসা নেই, তাই সন্তানরাও ঘরবন্দি। উপায়ান্তর না পেয়ে মোবাইল/ট্যাবে সময় কাটানোই হয়ে উঠছে শিশু-কিশোরদের বিনোদন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, ১৮ বছরের আগে কারও হাতেই কোনোভাবেই মোবাইল ফোন তুলে দেওয়া সমীচীন নয়। আমরা ক’জন এই বিধি-নিষেধগুলো গুরুত্ব দিচ্ছি? বেশ কিছুদিন আগের কথা, আমাদের দেশে তখন সবেমাত্র কম্পিউটারের যাত্রা ও টাইপরাইটার বদলে কম্পিউটারে লেখালেখি শুরু হয়েছে।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি উদ্যোগে কম্পিউটার প্রশিক্ষণও শুরু হয়েছে, কিন্তু তখনও অনেকের মধ্যেই কম্পিউটার ব্যবহারে আড়ষ্টতা কাজ করত। এ সময়গুলোতে গণমাধ্যমে কম্পিউটারে দক্ষতা আনয়ন ও এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে প্রচার-প্রচারণা চালানো হতো।

ঠিক এ ধরনের পরিস্থিতিতে টিভির কোনো এক অনুষ্ঠানে এক আলোচক বলেছিলেন, ‘আপনার সন্তানের খেলাধুলা ও বিনোদনের জন্য যে পরিমাণ টাকা-পয়সা খরচ করেন তা দিয়ে তাকে একটি কম্পিউটার কিনে দিন, কম্পিউটার হোক আপনার সন্তানের নিত্যসঙ্গী’।

এ ঘটনার প্রায় ৩০ বছর পর আজ বিশ্বের টেক জায়ান্টরা শিশুদের ওপর প্রযুক্তির বিরূপ প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ ও তাদের জন্য প্রযুক্তিবিহীন স্কুলের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। আমরা হয়তো জানিও না হাইটেক প্রযুক্তির পীঠস্থান সিলিকন ভ্যালির বাচ্চাদের কিছু কিছু স্কুলে কোনো কম্পিউটারই নেই।

ইন্টারনেটযুক্ত স্মার্ট ফোন একটি শিশুর শুধু শারীরিক সুস্থতাকে নয় পুরো মনোজগৎ এবং মানসিক বিকাশকেও চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারে। তাই তাদেরকে প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখার কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য প্রযুক্তি জায়ান্টরাও এখন সন্তানদের প্রযুক্তি পণ্যের বদলে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন জীবন গড়ার বই, যেন জীবন সম্পর্কে তারা জানতে পারে, মেধা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারে।

শিক্ষার্থীদের ভালো ভালো বই (হার্ড কপি) পড়তে আগ্রহী এবং একই সঙ্গে পরিচ্ছন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। ‘ভার্চুয়াল’ জগৎ অপেক্ষা ‘অ্যাকচুয়াল’ জগৎ যে আরও সুন্দর, আরও সমৃদ্ধ, আরও মনোমুগ্ধকর তা সন্তানের সামনে তুলে ধরতে হবে।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি