Loading..

সফলতার গল্প

১৮ ফেব্রুয়ারি , ২০২৪ ১০:৪৩ অপরাহ্ণ

দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তনই পারে সুন্দর আগামী গড়তে

আমি যখন এস.এস. সি পরীক্ষার্থী (১৯৯৪) তখন আমার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়, পরীক্ষার ঠিক একমাস আগে। স্টুডেন্ট ভালো ছিলাম। আমি পড়া ছাড়া কিছু বুঝতাম না। বাসার সবার আড়ালে শুধু  কান্না করতাম। কিছুই ভালো লাগতো না। যথারীতি পরীক্ষার সময় উপস্থিত হলো, পরীক্ষা দিলাম, স্টার পেলাম।


নিয়ম আগেও ছিলো এখনও আছে। নিয়ম তৈরি সহজ মানা কঠিন। আমার বাবা একজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষ, সে একজন হাই স্কুল টিচার, পৌরসভার মুসলিম ম্যারেজ রেজিস্ট্রার। কিম্তু আমার বিয়ে হলো মাত্র ১৬বছর বয়সে। রেজাল্টের পর পড়াশোনা বন্ধ হতে হতে কলেজে ভর্তি হলাম কোনো মতে। বিয়ের পর আমার অভিভাবকের সংখ্যা একাধিক। কত কিছু ম্যানেজ করতে হয়। বাংলার প্রতিটি ঘরের চিত্র একই। হোক উচ্চবিত্ত, হোক মধ্যবিত্ত, হোক নিম্নবিত্ত। সবার ক্ষেত্রে একই নিয়ম, বউ তো বউই।


প্রতিটি লেভেলের পরীক্ষা পাসের পর পড়ালেখা বন্ধ হতে হতে আবার শুরু করেছি। একা করেছি সেই যুদ্ধ। নির্বাক যুদ্ধ। চুপ থেকে কাজ করে গেছি। বাঙালি মেয়ে আমি, “বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না।" কিন্তু কাজে আমি পিছপা হবার মানুষই নই। আমার আছে মনোবল, আল্লাহর প্রতি ভরসা। সামনে এগিয়ে যাওয়ার নেশা। তাই তো  আমাকে কেউ টলাতে পারেনি লক্ষ্য থেকে। ডিগ্রী রেজাল্টের  ১০ দিন পর ছেলের "মা" হয়েছি। মাস্টার্স, বি. এড, এম. এড শেষ করেছি। সবচেয়ে বড় কথা আল্লাহর অশেষ দয়া  ছিলো আমার উপরে। তাই তো অনেক অসাধ্য সাধন করেছি অবলীলায়। একাডেমিক পড়ার বাইরেও প্রফেশনাল অনেক সার্টিফিকেট অর্জন করেছি। তারমধ্যে বেশ কিছু অনলাইন ও অফলাইন সার্টিফিকেটও আছে।


২০০৭ সালে শিক্ষকতার মত মহান পেশায় নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ। আমার পরিবারে আমরা মোট ছয়জন শিক্ষক। এই পেশার প্রতি অন্যরকমের একটা ভালোলাগা কাজ করে।


একজন শিক্ষক হিসাবে আমি অনেক সম্মানের অংশীদার হয়েছি। ৬টি বিষয়ের মাস্টার ট্রেইনার হয়েছি। এই সমাজ আমাকে অনেক সম্মান দিয়েছে। আমিও সব ঋণ পরিশোধ করে দিতে চাই। জানি সব শোধ করা সম্ভব হবে না। তবু্ও চেষ্টার কোন ত্রুটি থাকবে না। কোনো কাজে কখনও অবহেলা করিনি। যখন যে দায়িত্ব পেয়েছি, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করার প্রত্যয়ে এগিয়ে গিয়েছি। পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। এটা আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। যখন যে স্বপ্ন দেখেছি, সে নিমিত্তে কাজ করে গেছি। তাই তো আমি নিজেকে একজন আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ মনে করি। আমি যদি পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে শুধু ঘরকন্যা করতাম তবে কখনোই আমার চলার পথ এমন সহজ  হতো না।


২০০৭ সালে শিক্ষকতায় যুক্ত হওয়ার পর থেকে বেশকিছু প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছি। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ২০১৪ সালের ১৪দিনের ICT প্রশিক্ষণ। আমি অষ্টম ব্যাচে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। ঐ সময় প্রথম কনটেন্ট কম্পিটিশনের কথা শুনতে পারি। তখন স্মার্ট ফোন হাতে ছিল না । ইন্টারনেট তো বহু দূর। যাইহোক সেই থেকে স্বপ্ন দেখা শুরু। এরই মধ্যে আরও বিভিন্ন ধরনের কাজের সাথে যুক্ত হয়েছি।


২০১৬ সালে Aptitude test এর মাধ্যমে অনলাইনে পরীক্ষা দিয়ে Advanced ICT প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হই। ৪০দিন ব্যাপী চলে এই প্রশিক্ষণ। মূলত Advanced ICT প্রশিক্ষণই আমার ICT- তে চলার পথকে মসৃণ করে। বাংলা বিষয়ের শিক্ষক হয়েও ICTর প্রতি একটা অন্যরকমের ভালো লাগা কাজ করতো। ২০১৬ সালে আরও একটি অর্জন ছিলো Microsoft innovative educator expert (MIE Expert) হওয়া।


এদিকে অনেক পরিশ্রম করতে থাকি কনটেন্ট তৈরিতে। সেরা কনটেন্ট নির্মাতা হতে হবে, কনটেন্ট কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করতে হবে। অবশেষে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে ২০১৭সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে “সেরা কনটেন্ট” নির্মাতা নির্বাচিত হই। এছাড়াও ২০১৭ সালে ঝনকা বাজার উচ্চ বিদ্যালয় British Council কর্তৃক আয়োজিত International School Award(ISA) এ Full award অর্জন করেছে।  British Council এর Connecting Classrooms প্রোগ্রামের মাধ্যমে। উল্লেখ্য ঝনকা বাজার উচ্চ বিদ্যালয় ২০১৬ সালে International School Award(ISA- Intermediate) অর্জন করেছিল।  আমাদের শিক্ষার্থীরা দেশের ও দেশের বাহিরের বিভিন্ন স্কুলের  শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের কার্যক্রমগুলো শেয়ার করে থাকে। উল্লেখযোগ্য দেশগুলো  হলো- ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্থান, ইংল্যান্ড ইত্যাদি। বিভিন্ন স্কুলের সাথে আমি International coordinator হিসেবে কাজ করেছি। পরিশেষে আমি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ডিনেটর হিসাবে এবং  প্রতিষ্ঠান প্রধান মাননীয় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহোদয় ও বাংলাদেশ ব্রিটিশ কাউন্সিলের কর্তা ব্যক্তিদের হাতে অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করতে সক্ষম হই। এ অর্জন সত্যিই আমার কাজের গতিকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।


শিক্ষক বাতায়নে  ICT Ambassador হিসাবে সারাদেশ থেকে মাত্র ৬৮জন শিক্ষককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় করবী হলে। সেদিনটি ছিলো অত্যন্ত সম্মানের। ঐদিন থেকেই কিশোর বাতায়ন অনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। বিভিন্ন স্লাইড প্রদর্শনের মাধ্যমে আমাদের কিশোর বাতায়ন সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা হয়। ২০১৮ সালে আমি মুক্তাগাছা উপজেলার “শ্রেষ্ঠ শ্রেণি শিক্ষক” হিসাবে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের কাছ থেকে সনদ ও অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করি।


২০১৮ সালের জাতীয় পর্যায়ে কনটেন্ট কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করি এবং সেরা ৪৩ এর অন্তর্ভুক্ত হই। এই অর্জন আমাকে সীমাহীন আনন্দ দিয়েছে। পেয়েছি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের উপস্থিতিতে ক্রেস্ট, সনদ ও ল্যাপটপ। ২০১৮তে আরও একটি বড় অর্জন ছিলো – মুক্তপাঠ কর্তৃক আয়োজিত “ই-লার্নিং সফলতার গল্প প্রতিযোগিতা” ক্যাটাগরী “১”-এ  প্রথম হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি ১মিনিটের ভিডিও তৈরি করে।


২০১৯ সাল থেকে ধারাবাহিক মূল্যায়নের জেলা মাস্টার ট্রেইনারের দায়িত্ব পালন করে আসছি।  ২০২০সালে    Electric voting machine (EVM) এর মাস্টার ট্রেইনার হিসাবে নির্বাচিত হই।  এবং আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করি।




করোনাকালে, ২০২০ সালের মার্চের ১৭ তারিখের পর থেকে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ২৬ মার্চ থেকে ময়মনসিংহ অনলাইন স্কুল চালু হয়। সারাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে সর্বপ্রথম বাংলা বিষয়ের ক্লাস আমিই পরিচালনা  করেছিলাম।  ময়মনসিংহ অনলাইন স্কুল ছাড়াও, করোনাকালে বিভিন্ন অনলাইন স্কুলে ক্লাস পরিচালনা করেছি । ময়মনসিংহ অনলাইন স্কুলের আয়োজনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনের দায়িত্বও পালন করে থাকি। এছাড়াও আইসিটি শিক্ষক ফোরাম ও সেন্টার ফর কোয়ালিটি এডুকেশন এর ব্যানারে অনেক প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে , যেখানে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব্ব পালন করেছি । অনলাইনে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে (OBS studio, Steam yard, Google classroom, Google meet ইত্যাদি) অনলাইন ক্লাস ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেছি। নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ষষ্ঠ থকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত মাস্টার ট্রেইনারের দায়িত্ব পালন করেছি। মুক্তপাঠে কোর্স করা সহ অ্যাম্বাসেডরের দায়িত্ব পালন করেছি। CSSR প্রকল্পের অধিনে টেলিভিশন ক্লাসের জন্য স্ক্রিপ্ট রাইটিং ও ক্লাস পরিচালনা করেছি।


সর্বশেষ “শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী” হিসাবে ২০২৩ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর , মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আমাকে মুক্তাগাছা উপজেলা পর্যায়ে “শ্রেষ্ঠ জয়িতা” উপাধিতে ভূষিত করে সনদ ও ক্রেস্ট প্রদান করেন।


আমি স্বপ্নবাজ মানুষ। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখতে সাহস যোগাই। আমার স্কুলটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। স্কুলে অফিস-রুমে শুধু দুটি ফ্যান ছিলো। শ্রেণি কক্ষগুলোতে কোনো ফ্যান ছিলোনা। এই ব্যপারটি আমাকে দারুন ভাবে কষ্ট দিতো। সে সময় আমি উদ্যোগ নিয়ে প্রতিটি শ্রেণীকক্ষে ফ্যানের ব্যবস্থা করি। এখন সময় বদলেছে। স্কুলে চারতলা ভবন হয়েছে।


উল্লেখ্য দৈনিক প্রথম আলো প্রত্রিকায় বাংলা বিষয়ে আমার কয়েকটি লেখা ছাপা হয়। যা আমার জন্য ছিলো অত্যন্ত আনন্দের। এছাড়াও অনলাইন একটি পত্রিকায় আমার ইন্টারভিউ ছাপা হয়। যেটি শিক্ষক বাতায়ন ফেসবুক গ্রুপে বাতায়ন কর্তৃপক্ষ শেয়ার করেছিলেন। আমি বরাবরই শিক্ষক বাতায়নের কাছে কৃতজ্ঞ।


মুক্তপাঠে তিনটি কোর্সের স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসাবে কাজ করার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে।  মুক্তপাঠের কাছেও আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।  আমাকে স্ক্রিপ্ট রাইটার ও ভিডিও এডিটর হিসেবে তৈরি করার জন্য।




সময় বদলে গেছে। পরিবারের মানুষেরাও এখন সচেতন হয়েছেন। মেয়েরাও হ্যাঁ/ না বলতে শিখে গেছে। এখন আর একা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয় না। এখন সব সহজ, সুন্দর, সাবলীল।


দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে অনেকগুণ। এই নির্মল, সুন্দর, কণ্টকহীন পৃথিবীতে আমাদের সন্তানেরা সুন্দরমত বেড়ে উঠুক। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।


 


 


কাজী মনিরা তরফদার


সিনিয়র শিক্ষক (বাংলা)


ঝনকা বাজার উচ্চ বিদ্যালয়


মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।

আরো দেখুন