
পাহাড় থেকে সমগ্র দেশে

আমি রওশন শরীফ তানি।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাংগামাটি জেলাস্থ কাপ্তাই উপজেলার ব্যাপ্টিষ্ট মিশন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি।চাকুরীতে যোগদান করে ২০০৯ খ্রি. থেকে আজ অবধি শিক্ষকতা পেশায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছি নিজেকে।কচিকাঁচা শিক্ষার্থীদের একটু একটু করে গড়ে তোলা রীতিমতো আমার নেশায় পরিণত হয়েছে ।হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও অদম্য আমি পাহাড় থেকে ধীরে ধীরে আজ সারা দেশের অনেক গুণী ও মেধাবী শিক্ষকদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।পেয়েছি অনেক সম্মাননা ও স্বীকৃতি। জাতীয় শিক্ষা পদক ২০১৯ এ চট্টগ্রাম বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হবার গৌরব অর্জন করেছি।আন্তঃপিটিআই ক্রিড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও লোক সঙ্গীতে সেরা হবার গৌরব অর্জন করেছি।
খুব অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে যায়।বিয়ের পর নিজের লেখাপড়া,সংসার,সন্তানদের বড় করা,সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করার পাশাপাশি আমার চাকুরী।সব মিলিয়ে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়েছে প্রতিনিয়ত।পদে পদে হোঁচট খেয়ে পরতে পরতেই ফের উঠে দাড়িয়েছি।ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করেছি। মা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।খুব ছোট বেলায় বাবা মারা গিয়েছেন ,যার কারণে মাকে দেখেছি জীবন সংগ্রামে বীরের মত লড়াই করতে।মূলত তিনিই আমার জীবনের আদর্শ।মায়ের ইচ্ছাতেই শিক্ষকতা পেশায় এসেছি।
সৌন্দর্যের দিক দিয়ে রাংগামাটি অনেক এগিয়ে।কিন্তু পিছিয়ে আছে অনেক ক্ষেত্রেই।বিশেষ করে রাংগামাটির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের জন্য লেখাপড়া করে এগিয়ে যাওয়া অনেক বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়।এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের চেয়ে শিক্ষকের চ্যালেঞ্জটাই বেশি থাকে।
প্রথম যোগদান করেছিলাম কাপ্তাই উপজেলারই বারোঘোনিয়ামুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।এ বিদ্যালয়ের সামনে একটি বৌদ্ধবিহার ছিল।সেখানে পাহাড়ের অনেক গহীনে অজপাড়া গাঁ থেকে শিক্ষার্থীরা এসে থাকতো আর আমার বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করত।স্কুলে ভর্তি হবার পর কয়েক বছর তারা আমাদের সাথে কোন কথা বলত না।কিছু জিজ্ঞেস করলে ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকতো আবার মাঝে মাঝে কান্না করে দিত।এর কারণ ছিল তারা আমাদের কথা অর্থাৎ বাংলা বুঝতো না ,উত্তরও দিতে পারতো না। এসব দেখে আমার তাদের প্রতি আগ্রহ প্রবল হয়ে উঠেছিল।এটাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে কাজ করতে লাগলাম।নিত্য নতুন আইডিয়া আবিষ্কার করে তাদের কাছাকাছি পৌঁছাতে সক্ষম হলাম।নাচে,গানে, আনন্দের মাধ্যমে তাদের পড়ানো,ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহার করে তাদের সাথে নানা বিষয়ে ধারনা প্রদান,গল্পের আসর বসানো,বই পড়ার জন্য রিডিং ক্লিনিক ইত্যাদি নানা ইনোভেশনের মাধ্যমে তাদের পাঠদান দিতাম।একটু যখন বড় হত অর্থাৎ ৩য় কিংবা ৪র্থ শ্রেণিতে উঠে তারা মেধা তালিকায় শীর্ষে থাকতো।গান নাচ খেলাধুলায় ও এগিয়ে থাকতো তারা।ধীরে ধীরে তাদের প্রিয় শিক্ষকদের একজন হয়ে উঠলাম আমি।এ যেন আমার নতুন করে কাজ করার উদ্যোম খুঁজে পেতাম।৬বছর পর বদলী হয়ে বর্তমান বিদ্যালয়ে আজ অব্দি কর্মরত আছি।পূর্বের চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি এখানে মুখোমুখি হলাম নতুন চ্যালেঞ্জের।পাহাড়ের চূড়ায় আমার স্কুল। ১০০ এর বেশি সিঁড়ি বেয়ে স্কুলে পৌঁছাতে হয়।তার মধ্যে পানি নেই,স্কুল ভবন পুরোনো,খেলার মাঠ নেই,বর্ষায় পাহাড়ে উঠার সিড়িগুলোও বেশ পিচ্ছিল হয়ে যেত।নতুন স্কুলের জন্য আবারো নতুন ভাবনা।প্রধান শিক্ষকের সাথে আলাপ করে কাগজ দিয়ে স্কুলের দেয়ালকে সুসজ্জিত করলাম,পুরোনো বিল্ডিংকে রঙ করে বিদ্যালয়ে প্রান ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম।কাগজ দিয়ে নানা উপকরন তৈরি করে সিলিং এ ঝুলিয়ে দিলাম।শিক্ষার্থীদের সকালে শুভেচ্ছা জানিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করব বলে নিজ হাতে তৈরি করলাম ‘গ্রেটিং বোর্ড’।পাঠদানের পাশাপাশি নিয়মিত বিদ্যালয়ে গান -নাচ -আবৃত্তির অনুশীলন,গল্প বলার আসর,দেয়ালিকা তৈরি, উপকরণ তৈরি,বিদ্যালয় সজ্জিতকরণ,বাগান করা,নাটক করা,রিডিং ক্লিনিক,ল্যাংগুয়েজ ক্লাব ইত্যাদি নানা আইডিয়া প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের মনে একটি বিশেষ জায়গা দখল করতে পেরেছি।
২০১৪ সাল থেকে কন্টেন্ট তৈরি করে তা দিয়ে শ্রেণিতে পাঠদান করতে লাগলাম।তখন আমার বিদ্যালয় তো দূরের কথা,উপজেলার কোন বিদ্যালয়েই কোন ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটার নেই।নিজের পুরোনো ল্যাপটপ দিয়েই কাজগুলো করতাম।তারপর ২০১৬ সালে আইসিটি বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহন করে শিক্ষক বাতায়নে আইডি খুললাম।বাস,এবার আমার মনে হলো আমি আইসিটির এক বিশাল পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছি।কন্টেন্ট তৈরি,কন্টেন্ট আপলোড,মুক্তপাঠ থেকে নানা প্রশিক্ষণ গ্রহন ইত্যাদির মাধ্যমে আমি যেন একটু একটু করে নিজেকে শিক্ষার্থীদের জন্য আরো বেশি প্রস্তুত করতে লাগলাম।করোনা ক্রান্তিকালে নিজেকে আবিষ্কার করেছি একজন লড়াকু বীরযোদ্ধার মত করে।রাতদিন একমাত্র ল্যাপটপকে সঙ্গে করে আমি বিচরণ করেছি পুরো বাংলাদেশের অগণিত শিক্ষার্থীর হৃদয়ে।প্রথম দিকে নিজের ফেসবুকে ক্লাস রেকর্ড করে আপলোড করেছি।পরে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপ করে জুম এপ্স,গুগল মীট,ক্লাসরুম ইত্যাদি প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি প্রায় ৪০০ এর অধিক লাইভ ক্লাস সম্পন্ন করেছি।পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওয়ার্কশিট বিতরণ করেছি।দেশের সর্ববৃহৎ অনলাইন প্লাটফর্ম ‘ঘরে বসে শিখি’ তে ও আমি নিয়মিত লাইভ ক্লাস নিয়েছি।এই ক্লাসগুলো নেয়া আমার জন্য খুব সহজ ছিল না।কারণ রাংগামাটিতে সব জায়গায় নেটওয়ার্কের সুবিধা নেই।একটা রেকর্ডেট ক্লাস আপলোড হতে সময় লাগতো ১/২ দিন,তাও মাঝে মাঝে হত না।গভীর রাতে নেট কিছুটা ফ্রি পাব আশায় রাতের পর রাত জেগে ক্লাস আপলোড করতাম।পরবর্তীতে শুধুমাত্র ক্লাস নিব বলে আমি নিজের ঘর পরিবর্তন করে যেখানে নেটওয়ার্ক আছে সেখানে ঘর ভাড়া নিয়েছি।শুধু কি বাংলা ,গণিত ,ইংলিশ ? না।আমি লাইভক্লাস করেছি সঙ্গীত বিষয়েও।প্রাক প্রাথমিক শ্রেণি ও ১ম থেকে ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত গানগুলো নিয়ে আমি আলাদা আলাদা গান শেখার ক্লাস করেছি।সেসময় শিক্ষার্থীদের নিয়ে তৈরি মেসেঞ্জার গ্রুপ “Tani Miss’s little star’’গ্রুপটি এখনো সচল আছে। এ গ্রুপে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের পাঠ ,গান ছাড়াও কবিতা ,ছবি আঁকা,কাগজ দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা সহ নানা সৃজনশীল কাজ করে থাকে।আমার সহযোগিতায় তারা যখন সফলভাবে কিছু সম্পন্ন করে,আমার মনে হয় একটি রাজ্য জয়ের সমান সুখ আমি পাই।
কখোনো কোন কিছু পাওয়ার আশায় কাজ করিনি।ভালোলাগা,ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ থেকেই কাজ করি।তবুও অনেক স্বীকৃতি আমি পেয়েছি,পেয়েছি অনেক ভালোবাসা আর সম্মান যা আমার হৃদয়ে অমূল্য সম্পদ হিসেবে গচ্ছিত থাকবে আজীবন।
২০২১ সালের ৪ জানুয়ারী a2i আমাকে ICT4E জেলা এম্বাসেডর হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে যা আমার জন্য একটি বিশাল প্রাপ্তি।এছাড়া ২০২২ সালের আগষ্ট মাসে আমি সেরা অনলাইন পারফর্মার নির্বাচিত হয়েছি।কাজ করেছি CSSR প্রজেক্টের আওতায় রেডিও ও টেলিভিশনের জন্য স্ক্রিপ্ট ডেভেলপমেন্টের কাজ, a2i ও NCTB এর সাথে বর্তমানে কাজ করছি ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও শিক্ষক সহায়িকা এপ্সের জন্য।তাছাড়াও সারা দেশে অনেক শিক্ষকদের আইসিটি বিষয়ক সহায়তা প্রদান করছি যেমন পেমিস সফটওয়ারে তথ্য আপলোড ও আপডেট,শিক্ষার্থীর প্রোফাইল তৈরি,উপবৃত্তি কার্যক্রম ,মুক্তপাঠ থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহন,কন্টেন্ট তৈরি ইত্যাদি।নাগরিক সুবিধা থেকে অনেকটা দূরে থেকেও সারা দেশের অনেক মেধাবী শিক্ষকদের সাথে এইরকম বড় বড় কাজ করার সুযোগ পাওয়া আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়।আমি বিশ্বাস করি এই সকল কাজের সুযোগ পাওয়াও আমার জন্য এক একটা পুরষ্কার।আমার মত পাহাড়ের একজন শিক্ষককে এই সকল কাজের সুযোগ দিয়ে আমাকে আত্নবিশ্বাসী করার জন্য আমি আমার প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও a2i এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। a2i সব সময় একজন বন্ধুর মত পাশে থেকেছে।নিজেকে সমৃদ্ধ করার অনেক পথ আমি a2i এর মাধ্যমেই পেয়েছি। আমাকে পাহাড় থেকে সমগ্র দেশের সম্মুখে উম্নোচিত হবার সুযোগ দিয়েছে।আমার প্রত্যেকটি কাজের সফলতার তৃপ্তি এনে দিয়েছে।আমি আজীবন a2i এর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে চাই।
রওশন শরীফ তানি
সহকারি শিক্ষক
ব্যাপ্টিষ্ট মিশন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
কাপ্তাই,রাংগামাটি