
আমি বাতায়নকে ভালোবাসি, তাইতো বারবার বাতায়নে ফিরে আসি

আমি বেলায়েত হোসেন। পাঁচ ভাই-৪ বোনেরা মধ্যে আমি ষষ্ঠ। জন্ম মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার কালকিনি পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ জনারদন্দী গ্রামে।
ছোটবেলা থেকেই আমি পড়াশোনায় মেধাবী ছিলাম। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমি প্রতিটা শ্রেণিতেই প্রথম হতাম। পড়াশুনা এস এস সি-প্রথম বিভাগ, এইচ এস সি-প্রথম বিভাগ, বি এস এস-প্রথম বিভাগ, এম এস এস-রাষ্ট্র বিজ্ঞান-দ্বিতীয় শ্রেণি, প্রশিক্ষণ সি ইন এড-প্রথম বিভাগ, বি এড-প্রথম শ্রেণি, এম এড-2.74.
ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া করে আমি একদিন শিক্ষক হবো। এর পিছনে অবশ্য একটা কারণ রয়েছে বটে।স্কুল জীবন থেকেই আমার শিক্ষকদের এতো ভালোবাসা পেয়েছি যে, শিক্ষকদের কাছ থেকেই শিক্ষকতা পেশাটাকে হৃদয়ের কোণে জায়গা দিয়েছিলাম।
আলহামদুলিল্লাহ্! মহান আল্লাহ আমার সে আশা পূরণ করেছেন। অদম্য ইচ্ছে ছিল সংসার জীবনের পাশাপাশি কর্মজীবনেও সফলতার সাথে এগিয়ে যাওয়ার। প্রাপ্তির কোন আশাই মনের ভিতর কাজ করেনি তখন, শুধু সঠিক দায়িত্বটুকু পালন করে আন্তরিকতার সাথে শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়াই ছিল ব্রত।
২০০৬ সালের ০২ জুলাই কালকিনি উপজেলার ৮১ নং উত্তর রাজদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম যোগদানের মাধ্যমে আমার শিক্ষকতা জীবন শুরু। প্রত্যন্ত এলাকার অনুন্নত রাস্তা-ঘাট পেরিয়ে অনেক কষ্টে শিশির ভেজা ক্ষেত পাড়ি দিয়ে খুব ভোরে প্রায় ০৫ কিলোমিটার পথ আসা-যাওয়া করে আমাকে শিক্ষকতার মতো মহান পেশার দায়িত্ব পালন করতে হত। অতঃপর ২০১৩ সালে বর্তমান ০৫ নং দক্ষিণ জনারদন্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করে এখন পর্যন্ত কর্মরত আছি।
তবে, এতো কষ্টের পরেও আমি হতাশ হইনি। বরং এই প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু করে দেখানোর একটা চ্যালেঞ্জ মনে মনে পোষণ করেছিলাম। এর পেছনে অবশ্য কারণও ছিল। তা হলো আমিও জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠা একজন মানুষ। ২০০৯ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরু হলে আমার বিদ্যালয় থেকে নিয়মিত বৃত্তি পেতে শুরু করে। এর পূর্বেও এ প্রতিষ্ঠানটিতে বৃত্তি পেত। তবে সেটা নিয়মিত ছিল না। আমি এ প্রতিষ্ঠানে যোগদান করার পর বিনা পয়সায় শিক্ষার্থীদের কোচিং করাতাম।
২০১৪ সাল থেকে নিয়মিত বাতায়নে কনটেন্ট ভিজিট করতাম। শিক্ষক বাতায়ন থেকে কনটেন্ট ডাউনলোড করে নিজের মতো করে এডিট করে ক্লাস নিতাম। কিছুদিন এভাবে চলার পর মনে হলো আমি নিজের তৈরি কনটেন্ট দিয়ে পাঠদান করবো।
শিক্ষকতা পেশায় বড় পরিবর্তন এলো ২০১৭ সালে আইসিটি ইন এডুকেশন প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর। কেননা এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই জানতে পারি শিক্ষকদের সব চেয়ে বড় প্লাটফর্ম শিক্ষক বাতায়ন সম্পর্কে বিস্তারিত সব তথ্য। সেখানে গিয়ে পরিচিত হই ৩ জন স্বনাম ধন্য ইন্সট্রাকটর জনাব মুহাম্মদ শাহদাত হোসেন স্যার, জনাব মৃত্যুঞ্জয় মজুমদার স্যার, জনাব এস এম সিদ্দিকুর রহমান স্যার। শিক্ষক বাতায়নের আকাশে সেরা কন্টেন্ট নির্মাতাদের উড়তে দেখে আমার মনে স্বপ্ন তৈরি হল। আমিও কি বাতায়নের আকাশে উড়তে পারবো? যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, জয় আসবেই। তাই বিদ্যালয়ে কোন ল্যাপটপ না থাকলেও স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজে একটি ল্যাপটপ কিনে নিলাম।
২০১৭ সাল থেকে আমি বাতায়নে সক্রিয় হই, কনটেন্ট তৈরির কাজ শুরু করি এবং বাতায়নে আপলোড করি। বাতায়নে কাজ করতে গিয়ে আমি বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হলে ইন্সট্রাকটর জনাব হেলাল স্যার, জনাব নিশিত স্যার, জনাব প্লাবন সুমন স্যার, জনাব লুনা আক্তার ম্যাডামের পরামর্শ নিতাম।
২০১৮ সালে ফরিদপুর টিটি কলেজে কনটেন্ট প্রতিযোগিতায় গিয়ে পরিচিত হই শ্রদ্ধেয় প্যাডাগোজী এক্সপার্ট স্যার জনাব মোঃ রোকনুজ্জামান শিকদার, তার কাছ থেকে বাতায়ন সম্পর্কে ও কনটেন্ট তৈরী সম্পর্কে গুর্ত্বপূর্ণ ধারণা লাভ করি।
শুরু হল নির্ঘুম রাত জেগে কন্টেন্ট তৈরি করা ও বাতায়নে নিয়মিত আপলোড করা। মানসম্মত কন্টেন্ট তৈরি করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর শিক্ষক বাতায়নে ‘সেরা কন্টেন্ট নির্মাতা’ নির্বাচিত হই। আলহামদুলিল্লাহ প্রাণের প্লাটফর্ম বাতায়নের আকাশে উড়তে পারার স্বপ্ন পূরণ হলো।
অত:পর
শিক্ষক বাতায়নের নিয়মিত শর্তগুলো পূরণ করে কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ এটুআই কর্তৃক ২০১৯
সালের ২৫ জুলাই নির্বাচিত হই মাদারীপুর জেলার ‘আইসিটি জেলা অ্যাম্বসেডর শিক্ষক’
হিসেবে।
২০১৯ সালে এটুআই কর্তৃক আয়োজিত হাওড় পাড়ের শিক্ষক সম্মেলনে অংশ নেই। সেখানে গিয়ে পরিচিত হই জনাব মোহাম্মদ নবী হোসেন স্যার, সিনিয়র শিক্ষক, শিমুল কান্দী উচ্চ বিদ্যালয়। তিনি অনেক গুণী শিক্ষক।
এর
মধ্যে ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি দেখা দেয়, শ্রেণিকার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
ঘরে বসে যখন একঘেয়েমি লাগছিল, প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর খবর শুনতে শুনতে আমি
প্রায় ট্রমায় চলে যাচ্ছিলাম। তখন থেকে ভাবলাম মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে, নিজের
পরিবারকে ভাল রাখতে হলে সবার আগে আমার নিজেকে ভালোবাসতে হবে। নিজের মনের কথা শুনতে
হবে। তাই আমি ঠিক করলাম, বন্ধের মধ্যে আমি বেশি করে কনটেন্ট তৈরি করে রাখব যাতে করে পরবর্তীতে আমার কাজের সুবিধা হয়। এটা একসময় আমার ভালোলাগায়
পরিণত হলো। রুটিন অনুযায়ি আমি প্রতিটি শ্রেণির কনটেন্ট তৈরি করতে লাগলাম। পাশাপাশি
আমি বাতায়নে কনটেন্ট এর পাশাপাশি ব্লগ আপলোড করতে শুরু করি।
করোনাকালীন শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি
পূরণে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন-ওয়ার্কশীট বিতরণ, গুগল মীটে ক্লাস নেওয়া ইত্যাদি কাজগুলোতে অংশগ্রহণ করার
পাশাপাশি চেষ্টা করেছি নিজ উদ্যোগে কিছু করতে। এই যাত্রাপথে আমার প্রথম পদক্ষেপ
ছিলো নিজ আইডিতে রেকর্ডেড ক্লাস আপলোড করা। রেকর্ডেড ক্লাসের সিদ্ধান্ত নিতে
হয়েছিল। কিন্তু এতকিছু চ্যালেঞ্জকে জয় করে কাজ করার পেছনে আমাকে সাহস যুগিয়েছিল
‘শিক্ষক বাতায়ন’ প্লাটফর্ম। যেখানে সারা দেশের মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকগণ কাজ করে
চলেছে অবিরাম। যখনি কোনো সমস্যায় পড়েছি, সহযোগিতা পেয়েছি শতভাগ।
মানসম্মত
কন্টেন্ট তৈরি, উদ্ভাবনী গল্প, নেতৃত্বের গল্প আপলোড করে ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি শিক্ষক
বাতায়নে ‘উদ্ভাবনী শিক্ষক’ নির্বাচিত হই। আলহামদুলিল্লাহ প্রাণের প্লাটফর্ম
বাতায়নের আকাশে দ্বিতীয় বার উড়তে পারার স্বপ্ন পূরণ হলো।
আন্তরিক
কৃতজ্ঞতা জানাই প্রাণের শিক্ষক বাতায়নের প্রতি যে প্লাটফর্মটি আমার স্বপ্ন পূরণে সহায়ক
হিসেবে কাজ করেছে, সারাদেশে আমাকে করেছে পরিচিত। এভাবেই কাজ করে যেতে চাই দ্বিগুণ গতিতে
এবং বেঁচে থাকতে চাই আমার প্রিয় শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে।
শুকরিয়া
মহান আল্লাহতায়াল উপর, যিনি আমাকে কাজ করবার শক্তি ও সামর্থ্য দান করেছেন।