Loading..

সফলতার গল্প

অপরাজিতা
article

আমি সুমাইয়া তাবাসসুম, সহকারী শিক্ষক। বর্তমানে কর্মরত আছি নাগেরহাট নতুনকান্দি এম.বি. সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লৌহজং, মুন্সিগঞ্জে।প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে নিজ বিদ্যালয় থেকে শুরু করে শিক্ষা সংক্রান্ত সর্বস্তরে কাজ করার প্রয়াস চালাচ্ছি নিরলসভাবে।


আমার বাবা কাজির পাগলা এ. টি. ইনষ্টিটিউশন, লৌহজং-এর শিক্ষক ছিলেন। আমার মা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এছাড়াও তিনি কাজির পাগলা এ. টি. ইনষ্টিটিউশনের বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য ছিলেন, তখন আমি অত্র বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। আমার পরিবারে বাবা মায়ের তিন মেয়ের মধ্যে আমার অবস্থান তৃতীয়। বাবা মায়ের দৃঢ় মনোবল ছিলো আমাদের তিনবোনকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলা এবং তিনবোনকেই প্রতিষ্ঠিত করা।


ছোটবেলা থেকেই আমি পড়াশোনায় মেধাবী ছিলাম। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমি প্রতিটা শ্রেণিতেই প্রথম হতাম।সে ধারাবাহিকতায় দশম শ্রেণি পর্যন্ত মেধাস্থান বজায় ছিলো। বিদ্যালয় যাওয়ার পথ আমার মোটেও সুগম ছিলোনা। প্রায় ৫০ মিনিট পায়ে হেটে বিদ্যালয়ে যেতে হতো আমাকে। যেহেতু তখন এত অটো বা রিকশা চলাচল ছিলোনা।


লেখাপড়ায় এত আগ্রহী ছিলাম যে কোনদিন স্কুল কামাই দেইনি। বাড়ির পাশে খাল ছিলো। স্কুলে যাওয়ার সময় নৌকা পেলেও ফেরার পথে নৌকা পাওয়া যেতনা। তখন কর্দমাক্ত রাস্তা ঘুরে বাড়ির কাছে এসে অপেক্ষা করতাম নৌকার জন্য। বাবা মা কর্মজীবি হওয়ায় আমার সময়ের সাথে তাদের আসা যাওয়ার সময় মিলতোনা।


অনেক কষ্টে শিশিরভেজা ক্ষেত পাড়ি দিয়ে খুব ভোরে প্রাইভেট পড়তে যেতাম। ২০০৩ সালে আমি বানিজ্য বিভাগ থেকে এস. এস.সি. পাশ করি। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম সরকারি শ্রীনগর কলেজে বানিজ্য বিভাগে। এসময়ে যাতায়াত ব্যাবস্থা ভালো ছিলোনা বিধায় পায়ে হেটে প্রায় ৫ কিলোমিটার কলেজে যেতামকারণ আমাদের বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ডও দূরে ছিলো।


একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় ফাইনাল পরীক্ষার আগে আমার এপেন্ডিসাইটিস অপারেশন হয়। সবাই আমাকে পরীক্ষা না দেওয়ার পরমর্শ দেয়। কিন্তু নাছোরবান্দা আমি সে অবস্থাতেই ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেই এবং সফলতার সাথে উত্তীর্ন হই।


একাদশের অধ্যায় শেষ হলেই মাথায় চাপে আমি ইংরেজিতে অনার্স করবো। সে ভাবনা থেকে ভর্তি হই ঢাকা সরকারি কবি নজরুল কলেজে। কিন্তু এখানে সমস্যা আরোও প্রকট আকার ধারন করে। কারন ঢাকায় ভর্তি হলেও আমার ঢাকায় থাকার জটিলতা সৃষ্টি হয়। আমার সেখানে থাকার কোন জায়গা নেই। দৃঢ় মনোবলের আমি বাবা মায়ের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেই বাড়ি থেকেই ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করবো। কিন্তু এখানেও বাধা এসে দাঁড়ায়। বাড়ি থেকে ঢাকায় যাওয়া আসা করে পড়াশোনা করতে লাগলাম। আমার মনে পরে, সে সময়ে আমার গ্রামে আমি একাই যে কিনা গ্রাম থেকে শহরে নিয়মিত যাতায়াত করে পড়াশোনা করি। তাও আবার আমি কিনা একটি মেয়ে!


এরমাঝেই মা জানালেন প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগের সার্কুলার হয়েছে। আমার বড় দুবোনও পরীক্ষা দিবে, আমিও যেনো দেই যেহেতু আমি ইংরেজিতে খুব ভালো। পরীক্ষা দিলাম, আমাদের ছোট দুবোনের চাকুরী হয়ে গেলো। ২০০৬ সালের ২০শে এপ্রিল আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। এখানে এসেও সেই একই সমস্যা। বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথ প্রায় ৪০-৫০ মিনিট পায়ে হাটা পথ। ইরি ধানের ক্ষেতের আইলের পাশ দিয়ে হেটে আমি বিদ্যালয়ে সবার আগে পৌছে যেতাম। তবে শিক্ষকতায় যোগদান করে আমার জীবনের মোড় ঘুরে গেলো। শিক্ষার্থী, সহকর্মী, অভিভাবকদের ভালোবাসা আমাকে আপ্লুত করলো। ২০০৭ সালে আমি মুন্সিগঞ্জ পি-টি-আই থেকে সি-ইন-এড করি এবং প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হই। পরবর্তীতে আমি সরকারি কবি নজরুল কলেজ, ঢাকা থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করি এবং সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হই। উল্লেক্ষ্য, আমি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে পড়াশোনার পারমিশন নিয়ে বিদ্যালয় থেকে নিয়মানুযায়ী ছুটি নিয়ে পরীক্ষা দেই। এসময়েও আমি লৌহজং থেকে যাতায়াত করি।


২০১৪ সালে আমার বিয়ে হয়। স্বামী মোঃ মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া। এ মানুষটির কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। আমার সকল কাজকর্মে তিনি উদারভাবে সহযোগিতা ও সাহস দিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৫ সালে আমি একটি পুত্র সন্তানের মা হই। ওর নাম সাদিদ ইসলাম ভূঁইয়া। ছোট্ট এই সাদিদকে নিয়ে আমার অনেক যুদ্ধ। কেননা একক পরিবারে গৃহকর্মীর কাছে রেখে আমি সকল কাজকর্ম করা এবং বিদ্যালয়ের কাজে অংশগ্রহণ করে থাকি।


করোনাকালীন পুরো সময় জুরে আমি অনলাইনে ক্লাস নিয়েছি। মুন্সিগঞ্জ জেলায় আমিই সর্বপ্রথম অনলাইন ক্লাস শুরু করি। আমার ক্লাসগুলো মানসম্মত করার চেষ্টা করতাম। বিশ্বাসী ছিলাম কোয়ানটিটিতে না কোয়ালিটিতে। ক্লাসগুলোতে যুক্ত হয়েছে আমার বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও দেশের বিভিন্ন জেলার ছাত্র-ছাত্রীরা। আইসিটি ইন এডুকেশন a2i এর পরিচলানায় জনপ্রিয় ফেইসবুক পেইজ “ঘরে বসে শিখি” তে ক্লাস নিতাম প্রায় প্রতিটা ক্লাসই পেইজে মোস্ট পপুলার থাকতো আমার একটা ক্লাসের ভিউ প্রায় ৫০,০০০ এছাড়াও আমার বাসায় আমার উপজেলার অনেক শিক্ষকদের ক্লাস শুট করেছি। অনলাইন স্কুল লৌহজং-এ ক্লাস দিতে তাদের সর্বাত্বক সহায়তা করেছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীদের বাড়ি গিয়ে ওয়ার্কশীট বিতরন করেছি এছাড়াও গুগল মিটে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিয়েছি কিছু ছাত্রীকে নিজের বাসায় ক্লাস করার সুযোগ করে দিতাম যেহেতু তার বাড়িতে নেট সুবিধা ছিলনা এছাড়াও অন্যের বাড়িতে তারা যেনো ইভ-টিজিংয়ের স্বীকার না হয়।তাদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এ ব্যবস্থা নিয়েছিলাম


২০০৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আমি মুন্সিগঞ্জ পিটিআইতে স্মৃতি পরীক্ষায় ১ম স্থান অধিকার করি ২০০৯ সালের ২৫ শে জানুয়ারি আমি কাব শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষন গ্রহন করি এবং এপেয়ে উত্তীর্ণ হই ২০২০ সালে ২৯ জানুয়ারি আমি বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ের প্রশিক্ষণে এবং ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক বিজ্ঞান বিষয়ের প্রশিক্ষণে শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষনার্থী নির্বাচিত হই


২০১৯ সালে আমি জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক-২০১৯ এ মুন্সিগঞ্জ জেলায় শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক নির্বাচিত হই


২০২০ সালে আমি জাতীয়ভাবে সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে ইংরেজি বিষয়ে ক্লাস উপস্থাপন করি লৌহজং উপজেলায় আমিই একমাত্র শিক্ষক টেলিভিশনে ক্লাস উপস্থাপনের সেসময়ে লকডাউনে রাস্তাঘাট বন্ধ থাকলেও বিশেষ অনুমতিপত্রে আমি ঢাকার মোহাম্মদপুরে বাড়ি থেকে গিয়ে ক্লাস শুট করে আসি


আমি আইসিটি জেলা এম্বাসেডরমুন্সিগঞ্জ জেলায় প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে আমিই সর্বপ্রথম জেলা এম্বাসেডর। ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি আমি ICT4E District Ambassador,Munshiganj নির্বাচিত হই। এর জন্য আমাকে অনেক রাত জেগে কন্টেন্ট তৈরি করতে হয়েছে এরপরে শিক্ষার্থীদের জন্য আইডিয়া তৈরি করে জাতীয়ভাবে সেরা উদ্ভাবক হয়েছি ২ নভেম্বর২০২২ সালে


আমি জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড NCTB তে পরিমার্জিত শিখনক্রম নিয়ে বেশকিছু কাজ করেছি। ইতিমধ্যে আমি ১ম শ্রেণির শিক্ষক ডায়েরি এবং ২০২৪ সালের ৩য় শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবইয়ের নতুন কারিকুলামে প্রণিত বুক রিভিউতে কাজ করেছি


এছাড়াও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীনে (CSSR PROJECT) এ সারা বাংলাদেশ থেকে বাছাইকৃত শিক্ষকদের মধ্য থেকে ইংরেজি বিষয়ে নির্বাচিত হয়ে সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে ৫৫ টি এবং বাংলাদেশ বেতারে ৩২ টি রেডিও ক্লাস উপস্থাপন করেছি। ক্লাসের পাশাপাশি আমি অনলাইন এবং অফলাইনে বেশ কিছু উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছি।


এছাড়াও আমার কিছু পছন্দের কাজ আছে ,যা আমাকে আনন্দ দেয় যেমনঃ গান করাআবৃত্তি করাছবি আঁকাগল্প লেখাকাপড়ে ব্লক করাহ্যান্ড পেইন্ট করাকাঠের গহণা তৈরি করা।

 

আমার কাজের ক্ষেত্রে কোন বাধাই আমাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। পরিবার, শিক্ষার্থী, সহকর্মী, অভিভাভক, এলাকাবাসী সকলের দোয়া আমাকে একজন সফল সন্তান, সফল স্ত্রী, সফল জননী, সফল চাকুরীজীবি নারী হিসেবে গড়ে তুলেছে। অনেক বাধা অতিক্রম করে যে সফলতাগুলো নিজের জীবনে অর্জন করেছি তা নিম্নরুপঃ


১। উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক-২০১৯, লৌহজং, মুন্সিগঞ্জ।

২। জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক-২০১৯, মুন্সিগঞ্জ।

৩। স্মৃতি পরীক্ষা ১ম স্থান-২০০৭, পিটিআই,মুন্সিগঞ্জ।

৪। শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষনার্থী বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, ২০২০।

৫। শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষনার্থী প্রাথমিক বিজ্ঞান, ২০২০।

৬। সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে ইংরেজি ক্লাস উপস্থাপন।

৭। বাংলাদেশ বেতারে রেডিও ক্লাস উপস্থাপন।

৮। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুমোদিত a2i পরিচালিত শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম শিক্ষক বাতায়নের আইসিটি জেলা এম্বাসেডর 

 প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুমোদিত a2i পরিচালিত শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম শিক্ষক বাতায়নের দেশ সেরা উদ্ভাবক

১০। SEND (একিভূতকরণের কৌশলঃ শিখণ-শেখানো এবং মূল্যায়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণএর প্রশিক্ষক, লৌহজং, মুন্সিগঞ্জ।

১১। উপজেলা শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবক ২০২৩। উদ্ভাবনের বিষয়ঃ “Best Educator”


এইতো ছিলো আমার ছোট্ট এ জার্নির গল্প। আমি আমার বিদ্যালয়, শিক্ষার্থী এবং কর্মজগতে কি পেলাম কি পেলাম না এ হিসেব করিনি কোনদিন। বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের জন্য নিজেকে একজন অপরাজিতা ভাবতে চাই আজীবন। আমি বিশ্বাস করি আমার স্বপ্নগুলো আমার শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে এবং তাদের পড়াশোনায় সর্বাত্বক সহায়তা করার প্রচেষ্টা অব্যহত রাখতে পারলেই আমার এ জীবন স্বার্থক।

 


সুমাইয়া তাবাসসুম
সহকারী শিক্ষক
নাগেরহাট নতুন কান্দি এম বি এ
লৌহজং, মুন্সিগঞ্জ , ঢাকা
ইমেইলঃ sumaiyasadid2015@gmail.com
মন্তব্য করুন