
স্বপ্নবাজ এক ফেরিওয়ালার গল্প

আমি জান্নাতুল ফেরদৌসি, সহকারী শিক্ষক, নয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিবালয়, মানিকগঞ্জ।
বিগত ১৫ এপ্রিল ২০০৬ সালে আমার শিক্ষকতা জীবন শুরু হয়। ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া করে আমি একদিন শিক্ষক হবো। এর পিছনে অবশ্য একটা কারণ রয়েছে বটে। স্কুল জীবন থেকেই আমার শিক্ষকদের এতো ভালোবাসা পেয়েছি যে, শিক্ষকদের কাছ থেকেই শিক্ষকতা পেশাটাকে হৃদয়ের কোণে জায়গা দিয়েছিলাম।
আলহামদুলিল্লাহ্! মহান আল্লাহ আমার সে আশা পূরণ করেছেন। অদম্য ইচ্ছে ছিল সংসার জীবনের পাশাপাশি কর্মজীবনেও সফলতার সাথে এগিয়ে যাওয়ার। প্রাপ্তির কোন আশাই মনের ভিতর কাজ করেনি তখন, শুধু সঠিক দায়িত্বটুকু পালন করে আন্তরিকতার সাথে শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়াই ছিল ব্রত।
চাকুরির প্রথম জীবন সুখময় ছিলনা কারণ বাড়ি থেকে ভোর ৬ টায় বের হতে হতো। অতঃপর প্রায় দেড় ঘন্টা নদী পথ পাড়ি দিয়ে, তিন ঘন্টার বেশি পায়ে হেঁটে দুর্গম ফেলে বিদ্যালয়ে যেতে হতো! এত কষ্টের পরও চর এলাকার মানুষদের আন্তরিকতা ও সহযোগিতা আমাকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস যুগিয়েছে। এভাবে দীর্ঘ দুই বছর কষ্টের পর.. অবশেষে নিজ কর্মস্থল পরিবর্তন করে নদীর এপারে চলে আসি, সময়টা তখন ২০০৮ সালে।
২০১৩ সালে শাশুড়ি স্ট্রোক করলে শুরু হয় সংসার কর্মজীবনের পাশাপাশি আরেকটি দায়িত্বশীল জীবন। দিনের পর দিন শাশুড়ির পাশে রাত জেগে জেগে সময় কাটাতে হত আমাকে। আমার মাস্টার্স পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে এই রাত জাগাটাকেই আমি কাজে লাগাই।
আলহামদুলিল্লাহ্! সংসার, চাকুরি আর অসুস্থ শাশুড়ি মায়ের সেবা সবকিছু সামলে ঢাকা বাংলা কলেজ থেকে সম্মানের সাথে এম এ পড়াশোনা সমাপ্ত করি।
২০১৫ সালে আইসিটি ইন এডুকেশন বিষয়ক প্রশিক্ষণটি করার সুযোগ পাই। মূলত সেই থেকেই শুরু হয় এক অজানা জগতের সাথে পথচলার। ল্যাপটপের খুঁটিনাটি, বিভিন্ন আইসিটি বিষয়ক কাজ, কন্টেন্ট তৈরি থেকে শুরু করে যাবতীয় আইসিটি কাজ করতে থাকি।
এভাবে একদিন আমি শিক্ষক বাতায়নের সদস্য হই! সারাদেশের শিক্ষকদের প্রাণের জায়গা হলো এই শিক্ষক বাতায়ন। শুরু হয়, শিক্ষক বাতায়নের সাথে পথচলা।
শিক্ষক বাতায়নে অসংখ্য গূণী শিক্ষকদের কন্টেন্ট দেখে এবং শিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় দেখে আমিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। স্বপ্ন দেখি শিক্ষক বাতায়নে সেরা শিক্ষক হবার।
২০১৮ সালে শিক্ষক বাতায়নের নির্দিষ্ট নিয়মের ধারাবাহিকতা পালনের মধ্য দিয়ে আমার কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ এটুআই থেকে মানিকগঞ্জ জেলার অ্যাম্বাসেডর শিক্ষক নির্বাচিত হই।
এরপর শুরু হয় নির্ঘুম রাত জেগে জেগে কাজ করার পালা। আমার ঘরটাতে একদমই নেটওয়ার্ক পেতোনা। নেটওয়ার্কের জন্য আমাকে সব সময়ই ঘরের বাইরে এসে মোবাইলে কথা বলা এবং আইসিটি কাজ করতে হত। দিনের বেলা স্কুল আর রাতে ঘরের বাইরে বসে শিক্ষক বাতায়নে কনটেন্ট আপলোড দিতাম।
মহান আল্লাহর অশেষ কৃপায়, ২০১৯ সালের ৭ জুন শিক্ষক বাতায়নে সেরা কন্টেন্ট নির্মাতা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করি। আমাদের প্রাণের শিক্ষক বাতায়নের প্লাটফর্মে আমি নিজেকে প্রকাশ করতে সক্ষম হই।
শুরু হয় ২০২০ সালে করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি, বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের সকল প্রতিষ্ঠান। জেলা অ্যাম্বাসেডর হিসেবে বিদ্যালয়ের শিখন ঘাটতি পূরণের জন্য ঘরে বসে নিজ উদ্যোগেই শুরু করি অনলাইন ক্লাস। যেহেতু নেটওয়ার্ক সমস্যা তা,ই প্রথমে ঘরের বাইরে এবং পরে বাড়ি থেকে একটু দূরে যেখানে নেট পাওয়া যায় সেখানে, একজনের ঘরের একটা রুম আমি কিছু দিনের জন্য অনুরোধ করে নেই। এভাবে দীর্ঘ ৩ মাস চলে আমার অনলাইন ক্লাস।
মানিকগঞ্জ জেলায় সর্বপ্রথম মহিলা শিক্ষক হিসেবে আমি অনলাইন ক্লাস শুরু করি। নিজের চেষ্টা ও সারা বাংলাদেশের গুণী শিক্ষকদের সহায়তায় এই অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করতে সক্ষম হই। যার ফলশ্রুতিতে কর্মজীবনের ঝুলিতে জমা হয় এটুআই ও ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক মহাদোয় কর্তৃক “শিক্ষায় করোনা যোদ্ধা” সম্মাননা।
তাছাড়া, মানিকগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিসার কর্তৃক সর্বোচ্চ অনলাইন ক্লাস পরিচালনার জন্য পাই সম্মাননা।
মোট ৩০০’র বেশি অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করার সৌভাগ্য হয় আমার। শিক্ষক বাতায়নে আমার ১৭২ টি ক্লাস আপলোড দিতে সক্ষম হয়েছি।
২০১৯
সালে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হবার সৌভাগ্য অর্জন করি। ২০২১
সালে “জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ” শীর্ষক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষা ও চাকুরির
ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী ক্যাটাগড়িতে “শ্রেষ্ঠ জয়িতা” উপাধি অর্জন করি। ২০২২
সালে দেশের এবং দেশের বাইরের ৪টি স্কুল ও নিজের দেশের ২ টি স্কুল সহ আমার
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কিত ছবি, ভিডিও শেয়ারিং এর
মাধ্যমে কানেক্টিং ক্লাসরুম প্রজেক্টে কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। যার
ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে অর্জন করি “International School Award (ISA)” আর আমাকে
দেয়া হয় ISA কো-অর্ডিনেটর সম্মাননা।
বই পড়া ও বই লেখা আমার একটি শখ বলা যায়। স্কুল ও কলেজ জীবনেই দেয়াল পত্রিকায় ছাপা হত আমার নানা লেখা। স্বপ্ন দেখতাম আমার নিজের লেখা যদি একটা বই থাকতো! সে স্বপ্নের হাত ধরে ২০১৯ সালে আমার প্রথম ছোট গল্প “স্মৃতির বিকেল” অমর একুশে বই মেলায় প্রকাশিত হয়। এরপর ২০২০ সালে কুহেলিকা, একুশে বই মেলায় প্রকাশিত হয়।
“ইনোভেশন শোকেচিং ২০২৩” ভেন্যু টাঙ্গাইলে আমার ইনোভেশন নিয়ে অংশগ্রহন করার সৌভাগ্য হয় এবং সেখানে অর্জন করি যা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত। কর্মজীবনের ঝুলিতে জমা হয় আরেকটি সম্মাননা।
শিক্ষক হিসেবে আমি সত্যিই গর্বিত। ২০২২ ও ২০২৩ সালে মানিকগঞ্জ জেলায় মহিলা ক্যাটাগরিতে ২ বার “জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক” এর মর্যাদা অর্জন করি।
সর্বশেষ আল্লাহর অশেষ রহমতে চলতি বছর ২০২৪ এর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে মানিকগঞ্জ জেলার “শ্রেষ্ঠ গুণী শিক্ষক” নির্বাচিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি।
শ্রেষ্ঠ হবার স্বপ্ন কখনও দেখিনি। শুধু নিজের মধ্যে অদম্য একটা ইচ্ছে ছিল, নিরন্তর গতিতে কাজ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। কখনও ভাবিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের সম্মাননা পাবো কিন্তু পরিশেষে দেখেছি অদম্য ইচ্ছা আর কাজের প্রতি আন্তরিকতাই আমাকে এনে দিয়েছে এই সম্মান।
আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই প্রাণের শিক্ষক বাতায়নের প্রতি যে প্লাটফর্মটি আমার স্বপ্ন পূরণে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে, সারাদেশে আমাকে করেছে পরিচিত। এভাবেই কাজ করে যেতে চাই দ্বিগুণ গতিতে এবং বেঁচে থাকতে চাই আমার প্রিয় শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে।