
অমানিশা পেরিয়ে আলোর পথের যাত্রী

২০১২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বোয়ালখালী উপজেলার সর্বশেষ প্রান্তের স্কুল দক্ষিণ কড়লডেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম যোগদানের মাধ্যমে আমার শিক্ষকতা জীবন শুরু। প্রত্যন্ত এলাকার অনুন্নত রাস্তা-ঘাট পেরিয়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ আসা-যাওয়া করে আমাকে শিক্ষকতার মতো মহান পেশার দায়িত্ব পালন করতে হয়। কোন শিক্ষক এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করার পর বেশিদিন থাকতেন না। এর প্রধান কারণ হলো রাস্তাঘাটে যাতায়াতে দুর্ভোগ।
তবে এতো কষ্টের পরেও আমি হতাশ হইনি। বরং এই প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু করে দেখানোর একটা চ্যালেঞ্জ মনে মনে পোষণ করেছিলাম। এর পেছনে অবশ্য কারণও ছিল। তা হলো আমিও জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠা একজন মানুষ। যার পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যরত অবস্থায়। কারণ সপ্তম শ্রেনিতে অধ্যয়নকালীন আমার আব্বু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাদের পরিবারে নেমে আসে অমানিশা। যেখানে পরিবারের সদস্যদের মুখে অন্ন জোগানোর জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে সবাই ব্যস্ত, সেখানে পরিবারের বড় ছেলে হয়ে পড়ালেখা চালিয়ে নেয়াটা আমার জন্য অসাধ্য ছিল। কিন্তু আমার মায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং আমার অদম্য মনোবলের কারণে অনেক কষ্টে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করি।
তবে পড়ালেখা শেষ করতে গিয়ে প্রতি পদে পদে কঠিন বাধা আমাকে অতিক্রম করতে হয়েছিল। এদিকে, প্রত্যন্ত এলাকার বিদ্যালয়ে যোগদান করার পর থেকে প্রতিদিন এলাকাবাসীর নানা কটু কথা শুনতে হতো। এর পেছেনে অবশ্য অনেক কারণও আছে। প্রধান কারণটা হলো অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বিদ্যালয়টিতে বেশিদিন শিক্ষক না থাকা। শিক্ষক স্বল্পতায় এক প্রকার ধুঁকে ধুঁকে চলতে থাকে বিদ্যালয়টি। তবে মহান আল্লাহর কাছে সব সময় একটা সুযোগ চাইতাম, যেন নিজের সুনাম রক্ষা করে এলাকাবাসীর মনোভাব পরিবর্তন করতে পারি। অবশেষে ২০১৫ সালে সেই সুযোগটি মহান আল্লাহ আমাকে করে দিয়েছিলেন। জাতীয় ফুটবলে জেলা পর্যায়ে রানার্স আপ হওয়ার পর থেকে আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে থাকে পূর্বের চিত্র। একটি মাত্র খেলা পাল্টে দেয় পুরো এলাকার চিত্র।
শুরু হলো নতুন করে যাত্রা। আমাদের দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করার পর মেধাবীদের মধ্যে কেমন জানি একটা হতাশা পরিলক্ষিত হয়। তবে আমি ছিলাম এর ব্যতিক্রম। আমার লক্ষ্য ছিল শিক্ষকতা পেশার মাধ্যমে আমি নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদাভাবে পরিচিত করে তুলবো। বিদ্যালয়ের নামে নয়, আমার নামে আমার বিদ্যালয় পরিচিত হবে এটাই ছিল মটো। আইসিটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার আগে থেকেই আমার আইসিটিতে দক্ষতা ছিল। তবে ১২ দিনের আইসিটি প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করলাম কন্টেন্ট তৈরি করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় বিদ্যালয়ের জন্য নতুন করে চেয়ার, টেবিলের ব্যবস্থা করলাম।
উপজেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্দ নিয়ে মাঠ ভরাট, বর্ষাকালে চলাচলের জন্য রাস্তা নির্মাণ, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ করে বদলে দিতে লাগলাম বিদ্যালয়ের চিত্র। বিদ্যালয়ের এসএমসি, পিটিএ কমিটি, অভিভাববকদের নিয়ে উন্নয়ন কাজ চলতে থাকলো। কাব স্কাউটিং থেকে শুরু করে, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় একের পর এক সফলতার দেখা মিলতে লাগলো। শুধু তাই নয়, ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে কোনদিন কোন শিক্ষার্থী আমার বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক বৃত্তি পায়নি। আমি এই অসাধ্য সাধনেও সফল হয়েছি। এসব কাজ সম্পন্ন করার পেছনে অবশ্যই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন বেশি সহায়ক হয়েছিল। এলাকার গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি বছর খাতা, কলম, পোশাকের ব্যবস্থা করে ঝরে পড়া রোধে সফলতা ছিল অনস্বীকার্য।
বিদ্যালয়ের উন্নয়নের পাশাপাশি পেশাগত উন্নয়নে আমি সব সময় সজাগ ছিলাম। তাই মুক্তপাঠসহ দেশ বিদেশের অনেক অনলাইন পোর্টাল থেকে নানা প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে দক্ষ একজন শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। পাশাপাশি স্কাউটিং কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থেকে উডব্যাজ অর্জন করি। বর্তমানে আমি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কাব লিডারের দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছি। ২০১৭ সাল ছিল আমার শিক্ষকতা জীবনের সফলতার বছর। ঐ বছর জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক- ২০১৭ এর প্রতিযোগিতায় প্রথমবার অংশগ্রহণ করে চট্টগ্রাম জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হই। যা ছিল আমার জন্য বিশাল অর্জন। কখনো কল্পনাও করিনি চাকরি জীবনের মাত্র ৫ বছরে এমন একটা অর্জন আমার সফলতার পালকে যুক্ত হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক, ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বিভাগের শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক, ২০২৩ সালে বোয়ালখালী উপজেলার শ্রেষ্ঠ কাব শিক্ষক এবং ২০২৪ সালে বোয়ালখালী উপজেলার শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক নির্বাচিত হই।
তবে মহান আল্লাহ চাইলে যাকে ইচ্ছে সম্মান দিতে পারেন। সেটার প্রমাণ পেয়েছি ২০১৯ সালের জুন মাসে এসে। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হওয়ার ফলস্বরূপ বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ২০১৯ সালের ২৬ জুন বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা সফরে প্রথম ফিলিপাইন ভ্রমণের সুযোগ পাই। ফিলিপাইনের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় “ইউনিভার্সিটি অব দ্যা ফিলিপাইন্সে” প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং দর্শনীয় স্থান দেখা আমার শিক্ষকতা জীবনে মাইলফলক হয়ে থাকবে। একের পর এক সফলতার মাঝেও শিক্ষক বাতায়নের চট্টগ্রাম জেলা অ্যাম্বাসেডর হওয়াটা ছিল অনন্য এক অর্জন। এই অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অনেক গুনী, মেধাবী শিক্ষকদের সাথে পরিচিতি, পাশাপাশি আইসিটিতে নিজেকে অধিকতর দক্ষ করার প্রয়াসে এগিয়ে চলা। এ যেন সৃষ্টিকর্তার পরম পুরস্কার।
চাকরিতে যোগদানের পূর্বে কখনো কল্পনাও করিনি এতো এতো অর্জন মহান আল্লাহ আমার জন্য বরাদ্দ রেখেছেন। আমার লক্ষ্য ছিল একটাই, সততা, আন্তরিকতা আর নিষ্ঠার সাথে শিক্ষকতার মতো মহান দায়িত্বটা পালন করার। তবে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এখনো সেই প্রত্যন্ত এলাকার বিদ্যালয়েই আছি। তবে প্রত্যন্ত এলাকার সেই স্কুল এখন আগের মতো নেই। পড়ালেখা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, খেলাধুলা, কাব স্কাউটিংসহ কোন ক্ষেত্রেই পিছিয়ে নেই আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে উপজেলা সদরের অনেক নামকরা স্কুলের সফলতার চেয়ে আমার বিদ্যালয়ের সফলতা অনেক বেশি।
দিনশেষে প্রাপ্তির হিসেব করে শুধু এইটুকুই বলি, পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আন্তরিকতা থাকলে যেকোন পরিবেশ থেকেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব। সফলতার জন্য ছুটতে হয় না। আন্তরিকভাবে কাজ করলে, কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকলে সফলতা নিজ থেকেই ধরা দিবে। যার প্রমাণ আমি নিজেই। তাই আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেকে নিয়ে সব সময় গর্ববোধ করি।