
দীপ জ্বেলে যাই

দ্বীপ উপকূলে জন্ম আমার, এখানেই বাস। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে জন্ম থেকেই করেছি সখ্যতা। কখনো হার মেনে না নিয়ে প্রতিবার নব উদ্যমে জেগে ওঠা- প্রকৃতির কাছেই শিখেছি। প্রকৃতিই আমার প্রথম শিক্ষক।
শৈশবে নৌকাডুবিতে মা’কে হারিয়ে শিক্ষক বাবার একক প্রচেষ্টায় সাংস্কৃতিক সংস্কারে আমার বেড়ে ওঠা। বাবাকে দেখে ভাবতাম- বড় হয়ে আমিও বাবার মতো শিক্ষক হবো।
শিক্ষকতা-এই মহান পেশাতেই নিয়োজিত আছি প্রায় ১৭ বছর ধরে। আমি শমসের নেওয়াজ মুক্তা, কর্মরত আছি কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপজেলার ফ্লা লে কাইমুল হুদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে লোকপ্রশাসন বিভাগে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছি।
মূল ভূখণ্ড থেকে কুতুবদিয়া বিচ্ছিন্ন হলেও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এবং মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের স্বপ্ন থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হইনি। কাজ করে চলেছি শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে, অদম্য স্বপ্ন বুকে নিয়ে। নিজের স্বপ্নপূরনে অবিচল ও কাজে নিবেদিতপ্রাণ ছিলাম বলেই পেয়েছি বিভিন্ন কাজের স্বীকৃতি ও অর্জন করেছি সকলের ভালোবাসা।
আমি প্রধানত কাজ করেছি তিনটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে, যা আমাকে নিজ কর্মস্থলের গন্ডি পেরিয়ে নিজ উপজেলা, জেলা ও বিভাগেও সফলতা এনে দিয়েছে। যেমন:
১। শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক মননে সমৃদ্ধ করা
২। প্রাথমিক শিক্ষায় আইসিটির ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং
৩। পাঠদানে আনন্দমুখর পরিবেশ সৃষ্টি ও সৃজনশীল পদ্ধতি প্রয়োগ করা।
আমি কখনই মনে করিনা যে, বছর শেষে দু-চারটা বৃত্তিই বিদ্যালয় বা শিক্ষার্থীর জীবনে সফলতা এনে দিতে পারে। তাই পাঠদানে শিখন শেখানো কৌশলে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রয়োগ ও বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে সকল ধরনের সহঃশিক্ষাক্রমিক কার্যাবলীর উপস্থিতি ঘটিয়ে নিজ বিদ্যালয়কে গ্রেডে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি। এছাড়াও ‘পরিবর্তনের পথে, সুন্দরের সাথে’ স্লোগানকে ধারন করে প্রধান শিক্ষকের সহায়তায় পরিবর্তন করেছি নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইউনিফর্ম, বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশ।
করোনাকালীন শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন- ওয়ার্কশীট বিতরণ, গুগল মীটে ক্লাস নেওয়া ইত্যাদি কাজগুলোতে অংশগ্রহণ করার পাশাপাশি চেষ্টা করেছি নিজ উদ্যোগে কিছু করতে। এই যাত্রাপথে আমার প্রথম পদক্ষেপ ছিলো নিজ আইডিতে এবং দেশের কিছু উল্লেখযোগ্য শিক্ষামূলক পেজ’এ রেকর্ডেড ক্লাস আপলোড করা। রেকর্ডেড ক্লাসের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল কারন আমার উপজেলায় ছিলোনা বিদ্যুৎ সুবিধা, ছিলোনা ভালো নেটওয়ার্ক, ছিলোনা অন্যান্য সুবিধাসমুহ। কিন্তু এতকিছু চ্যালেঞ্জকে জয় করে কাজ করার পেছনে আমাকে সাহস যুগিয়েছিল ‘শিক্ষক বাতায়ন’ প্লাটফর্ম। যেখানে সারা দেশের মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকগণ কাজ করে চলেছে অবিরাম। যখনি কোনো সমস্যায় পড়েছি, সহযোগিতা পেয়েছি শতভাগ। পরিশ্রমের ফলস্বরূপ নির্বাচিত হয়েছি কক্সবাজার জেলার সর্বপ্রথম অ্যাম্বাসেডর শিক্ষক (২৯শে নভেম্বর, ২০২০), যা আমার জন্য অত্যন্ত গৌরবের। তাছাড়া দ্বীপ এলাকার সমস্ত প্রতিকুলতা পেরিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনলাইন ক্লাস নিয়ে আমার উপজেলাকে ছাড়িয়ে দেশের সর্বত্র শিক্ষার্থী ও অভিভাভকদের নিকট পৌঁছার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। কুতুবদিয়া উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক পেয়েছি “করোনাযোদ্ধা” সম্মাননা।
শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধকল্পে, স্কুলে উপস্থিতি নিশ্চিতকরনে এবং শিক্ষার্থীদের শিখনফল অর্জন ও দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য নিত্য নতুন উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করে চলেছি। যেমন- “চলো আমরা ক্লাস সাজাই/মনের আনন্দে স্কুলে যাই”, “বাগান করি স্কুলে আসি/ফুলের হাসি ভালোবাসি”, “এসো গল্প শুনি/ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানি”, “খেলতে খেলতে শিখবো মোরা/স্বপ্ন মোদের দেশ গড়া” ইত্যাদি। এই উদ্ভাবনী ধারনা এবং কাজগুলো আমাকে এনে দিয়েছে শিক্ষক বাতায়ন কর্তৃক “সেরা উদ্ভাবক” স্বীকৃতি (১লা মে, ২০২৩) এবং বিভাগীয় ইনোভেশন শোকেসিং’২৩ এ পেয়েছি অংশগ্রহণের সুযোগ।
শিখন শেখানো কৌশলে আনন্দমুখর পাঠদান, পাঠদানে ডিজিটাল কন্টেন্ট এর ব্যবহার, বিদ্যালয়ে শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে নিত্য নতুন উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের প্রতিভা বিকাশে এবং সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার উদ্দেশ্যে কাজ করে চলেছি গান, নাচ,কবিতা আবৃতি, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন, কাবিংসহ আরও বিভিন্ন সহঃশিক্ষাক্রম কার্যাবলী নিয়ে। এতে করে আমার শিক্ষার্থীরা তাদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগে। এছাড়াও দ্বীপ উপজেলার পুরো সাংস্কৃতিক আবহে পরিবর্তন আনার উদ্দেশ্যে আমি প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছি কুতুবদিয়া শিল্পকলা একাডেমীতে। উল্লেখ্য যে, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ’০৯ এ আন্তঃপিটিআই সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় নজরুল সংগীত এবং লোক নৃত্যে আমি জাতীয় পুরস্কার অর্জন করি।
শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি- তাদের অভিভাবকদের সেই কাজে সম্পৃক্ত করলেই কাজটিতে সফলতা আসে। তাই আমার সকল নতুন কাজে এবং শিক্ষক-শিক্ষারথী-অভিভাবকদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে গিয়ে আমাকে কখনওবা অবতীর্ণ হতে হয়েছে সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায়। এটাও আমার সফলতায় একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিলো।
কাজের প্রতিটি চ্যালেঞ্জই আমার শক্তি, পরবর্তী কাজের অনুপ্রেরণা। একেকটি স্বপ্ন পুরন হয়, আর আমি নব উদ্যমে পরবর্তী কাজে নেমে পড়ি। এভাবেই শুধুমাত্র নিজ কর্মক্ষেত্রেই নয়, গোটা কুতুবদিয়া উপজেলার সাংস্কৃতিক আবহে আমি আমুল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছি। শিক্ষা ও চাকুরিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য পেয়েছি “জয়িতা’১৩” পুরস্কার। শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি ২০১৪ (উপজেলা, জেলা পর্যায়), ২০১৯ (উপজেলা ও জেলা পর্যায়) এবং ২০২৩(উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়), অধিদপ্তর কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে “শ্রীলংকা সফর”এর সৌভাগ্য অর্জন করেছি (২০১৬খ্রি)। এছাড়াও ব্লেন্ডেড শিক্ষায় ডিজিটাল এক্সেস ও শিক্ষকের সক্ষমতা শীর্ষক সম্মেলনে পেয়েছি বিভাগীয় শিক্ষক সম্মাননা। এবং সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন বাংলাদেশ কভিড-১৯ স্কুল সেক্টর প্রকল্প ও ইউনিসেফ বাংলাদেশ কর্তৃক ডিজিটাল কন্টেন্ট উন্নয়ন, ইংরেজি বিষয়ের উপর স্ক্রিপ্ট রাইটিং ও টেলিভিশনে পাঠদান এর জন্য নির্বাচিত হয়েছি। সম্প্রচারিত হয়েছে বেশ কিছু ক্লাস।
উপরোল্লিখিত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতাগুলো প্রকৃতপক্ষে আমার একেকটি সংগ্রামের নীলকাব্য।
আমি মনে করি- শিক্ষকতা পেশাটি সর্বোচ্চ সম্মানের। আমি চাই, মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরনে এবং আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমার পদক্ষেপগুলো জাতীয় অঙ্গনে পরিচিতি পাক। শিক্ষক বাতায়নের হাত ধরে প্রাথমিক শিক্ষায় ডিজিটালাইজেশন যে আমার মতো শিক্ষকদের হাত ধরে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে – এটা সবাই জানুক। অনুপ্রাণিত হয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ুক আমার মতো হাজারো সাধারণ শিক্ষক।